টেকনাফের দর্শনীয় স্থান সমূহ
আপনারা যারা বাংলাদেশের সর্ব-দক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ ভ্রমণ করতে যেতে চাচ্ছেন তাদের জন্য টেকনাফের দর্শনীয় স্থান সমূহ আজকের ভ্রমণ টিপস আর্টিকেলে উল্লেখ করবো।
টেকনাফ বাংলাদেশের সর্ব-দক্ষিণে কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। কক্সবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে টেকনাফ অবস্থিত। নাফ নদীর নাম অনুসারে এই উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে টেকনাফ। টেকনাফ উপজেলার মোট আয়তন ৩৮৮.৬৮ বর্গ কিলোমিটার।
টেকনাফ মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত এবং সমুদ্র সৈকত ও দ্বীপের দেশ হিসাবে টেকনাফ বিশেষ ভাবে পর্যটকদের কাছে বিশেষ ভাবে পরিচিত। টেকনাফ তার মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক স্থানের জন্য বিখ্যাত।
আজকের আর্টিকেলে টেকনাফ উপজেলার দর্শনীয় স্থান গুলো উল্লেখ করবো। আপনারা যারা টেকনাফ ভ্রমণ করতে চাচ্ছেন তারা নিচে উল্লেখ করা টেকনাফের দর্শনীয় স্থান গুলো অবশ্যই ঘুরে দেখবেন।
টেকনাফের দর্শনীয় স্থান সমূহ
(১) শাহপরীর দ্বীপ
শাহপরীর দ্বীপ নাফ নদীর মোহনায় বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। শাহপরীর দ্বীপ টেকনাফের সর্ব দক্ষিণের ভূ-ভাগের একটি দ্বীপ, যা টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নে অবস্থিত।
অনেকের মতে সম্রাট শাহ সুজার “শাহ” এবং তার স্ত্রী পরীবানুর “পরী” নাম মিলিয়ে এই দ্বীপের নামকরণ শাহপরীর দ্বীপ করা হয়েছিল। আবার কারো মতে শাহ ফরিদ আউলিয়ার নাম অনুসারে এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল।
শাহপরীর দ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় মৌসুমি বায়ুতে। এই দ্বীপে রয়েছে তিনটি সমুদ্র সৈকত। এই সৈকত গুলোতে কোন লাইফ গার্ড ব্যবস্থা সেই, এজন্য জোয়ার ভাটার সংকেতের কোনো চিহ্ন থাকে না। তাই পর্যাটকদের জোয়ার ভাটার সময় জেনে সমুদ্রে নামার অনুরোধ করা হল।
এই দ্বীপে রয়েছে জেলেপাড়া এবং জেলেপাড়ার পাশেই দিগন্তজোড়া লবন ক্ষেত। এই লবন ক্ষেতের পাশে রয়েছে ছোট ছোট নদী, যেখানে নানা ধরনের অতিথি পাখি দেখতে পাবেন।
(২) টেকনাফ সমুদ্র সৈকত
টেকনাফের সবচেয়ে জনপ্রিয় হল টেকনাফ সমুদ্র সৈকত। নীল জলরাশী, সাদা বালি এবং দীর্ঘ সৈকতের জন্য টেকনাফ সমুদ্র সৈকত বিখ্যাত। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের থেকেও টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের জল অনেক বেশি পরিস্কার এবং নীল।
সমুদ্র সৈকতের পাশে রয়েছে ঝাউবন। এখানে পর্যাটকদের দেখা তুলনামূলকভাবে কম হলেও অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা (সামপাম) দেখতে পাবেন। এই সমুদ্র সৈকতে বেশিভাগ জেলেরা মাছ ধরে।
(৩) সেন্টমার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপ
টেকনাফ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বলে এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল ছেঁড়া দ্বীপ। এই দ্বীপ জোয়ারের সময় এক-তৃতীয়াংশ পানিতে ডুবে যায়, আর সাগরের নীল ঢেউ যখন পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে তখন এক মোহনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের চারপাশে কেওড়া গাছের বিস্তার, আর নারিকেল গাছ দ্বারা পরিপূর্ণ। এখানে থাকার জন্য উন্নত হোটেল রয়েছে, সেখানে আপনারা সুন্দর পরিবেশে থাকতে পারবেন।
এখানে নানা প্রজাতির জীব বৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১৩০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী সামুদ্রিক জীব এবং ৪ প্রজাতির উভয়চর জীব। চাঁদনী রাতে যেকোনো পর্যাটকদের এই দ্বীপের মুগ্ধকর পরিবেশ আকর্ষিত করে।
(৪) মাথিনের কূপ
টেকনাফ থানার প্রাঙ্গনে অবস্থিত মাথিনের কূপ। প্রেমের আত্মত্যাগের নিদর্শন হিসাবে এই কূপটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে ধীরাজ নামে একজন সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তা টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন।
একদিন সকালে তিনি থানার বারান্দায় এসে দেখেন কিছু রাখাইন কন্যারা সুউচ্চ কলহাস্যে কূয়া প্রাঙ্গন মুখরিত করছে। সেখানে ধীরাজ দেখতে পান টেকনাফের জমিদারের একমাত্র কন্যা মাথিনকে। প্রতিদিন মাথিনের জল নিতে আসায় ধীরে ধীরে ধীরাজ ও মাথিনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
তারা দুজন সিধান্ত নেয় বিয়ে করবে। এর মাঝে কলকাতা থেকে ধীরাজের বাবার চিঠি আসে কলকাতায় তাকে ফিরে যাওয়ার জন্য। মাথিনকে না জানিয়ে ধীরাজ কলকাতা ফিরে যায়।
এরপর ১৪/১৫ বছর মাথিন ধীরাজকে না পেয়ে থানার কূপে আত্মত্যাগ করেন। সেই থেকে এই কূপের নামকরণ করা হয়েছিল মাথিন কূপ। তাছাড়া তাদের প্রমের সাক্ষী হয়ে আছে এই মাথিন কূপ।
(৫) কালো রাজার সুড়ঙ্গ
কক্সবাজার রামু উপজেলার পাহাড়ি নালা পার হয়ে যাওয়ার পর দেখার মতো ঐতিহাসিক একটি স্থান হল সুড়ঙ্গ। কক্সবাজার ইতিহাস গ্রন্থে এই সুড়ঙ্গের কথা বর্ণানা দেওয়া হয়েছে। যাকে অনেকে কানা রাজার সুড়ঙ্গ বলে। এই সুড়ঙ্গপথের দৈর্ঘ ৩৫০ ফুট। এর মধ্যে ৭০ ফুট পায়ে হেটে যাওয়া পর হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে।
সুড়ঙ্গের মধ্যে অনেক পুরনো বড় একটি বৈঠকখানা রয়েছে, যার দেয়ালে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অনেক ছবি। সুড়ঙ্গের একটু ভিতরে গেলে দেখা যায় চারটি সুড়ঙ্গপথ। যেখানে অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে।
(৬) তৈঙ্গা চূড়া
টেকনাফ থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে তৈঙ্গা চূড়া অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তর সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যার পূ্র্বপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নাফ নদী, এরপর মায়ানমার সীমান্ত এবং তার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ ফুট উচ্চতায় তৈঙ্গা চূড়া অবস্থিত। এই বনের আয়তন ১১ হাজার ১২০ হেক্টর। তৈঙ্গা চূড়া সংরক্ষিত বনের উল্লেখযোগ্য গাছ হল গর্জন, চাপালিশ, আশোক, জলপাই ইত্যাদি। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ বন্য এশীয় হাতি এই বনে দেখতে পাবেন।
এছাড়া ১৩০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভয়চর, ২৮৫ প্রজাতির পাখি এবং ২৯০ প্রজাতির বিভিন্ন উদ্ভিদ রয়েছে। এই বনের আশে-পাশে মারমা, চাকমা ও রাখাইন আদিবাসীরা বাস করে।
(৭) শামলাপুর সৈকত
টেকনাফ শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে শিলখালী সুউচ্চ গর্জন বনের মধ্যে দিয়ে ১০ কিলোমিটার পথ গেলেই শামলাপুর সৈকত দেখতে পাবেন। অধিকাংশ সময় জনমানবহীন থাকে এই সৈকত। যারা ভ্রমণে নির্জনতা পছন্দ করেন তাদের জন্য শামলাপুর সৈকত আদর্শ স্থান।
এই সৈকতের তীর ঘেঁষে ছোট মাঝারি আকৃতির ঝাউ বনের জঙ্গল এবং নীল জলরাশীতে সারি সারি পাথর দেখতে পাবেন। এছাড়া লাল কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক এবং সমুদ্র জুড়ে রয়েছে জেলেদের সারি সারি মাছ ধরার নৌকা।
(৮) নাফ নদী
বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত নাফ নদী। এই নদীর ডান পাশ তীরে বাংলাদেশ এবং বাম পাশ তীরে মায়ানমার অবস্থিত। এই নদীর দৈর্ঘ ৬৩ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৩৬৪ মিটার এবং গভীরতা ৪২০ ফুট আনুমানিক।
সকল পরিক্ষার রেজাল্ট দেখুন: Education Board Results
আরাকান ও অন্যান্য পাহাড় থেকে নাফ নদীর উৎসরিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের অংশে মিলিত হয়েছে। এজন্য এই নদীর পানি লবণাক্ত। সেন্টমার্টিন দ্বীপে যেতে হলে এই নদী দিয়ে যেতে হয়। জাহাজে এই নদী দিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সময় অসংখ্য পাখি দেখতে পাবেন। পর্যাটকেরা নৌকায় করে এই নাফ নদীতে ঘুরে বেড়ায়।
(৯) টেকনাফ জেটিঘাট
টেকনাফ জেটিঘাট হল জাহাজ, নৌকা, ট্রলার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই জেটিঘাট পর্যাটকদের কাছে একটি আকর্ষনীয় স্থান। এখানে অসংখ্য লোকজনের আনাগোনা দেখতে পাবেন।
জেটিঘাটের পাশে রয়েছে রেস্টুরেন্ট, দুপাশে পর্যাটকদের বসার জন্য রংবেরঙের ছাড়া ও চেয়ার। যেখানে পর্যটকেরা বসে নাফ জেটিঘাট ও নাফ নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
(১০) গর্জন বাগান
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা এলাকায় গর্জন বাগান অবস্থিত। টেকনাফ থেকে সিএনজি যোগে গর্জন বাগানে যেতে পারবেন। এখানে সারি সারি গর্জন গাছ দেখতে পাবেন।
গর্জন গাছ গুলো মাদার ট্রি (মাতৃগাছ) হিসাবে সংরক্ষণ রাখা হয়েছে। এসব গাছের বীজ থেকে প্রত্যেক বছর হাজার হাজার গর্জন গাছের চারা উৎপাদন করা হয়।
এছাড়া টেকনাফ উপজেলায় অন্যান্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে:
- কুদুমগুহা
- মারিশবনিয়া সৈকত
- টেকনাফ ন্যাচার গেম রিজার্ভ
- সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক
- দেবতার পাহাড়
- টেকনাফ বাজার
কিভাবে টেকনাফ যাবেন?
বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে টেকনাফ যাওয়ার জন্য প্রথমে কক্সবাজার যেতে হবে। সড়ক ও বিমান পথে কক্সবাজার যেতে পারবেন। কক্সবাজার থেকে খুব সহজে বাস, সিএনজি, প্রাইভেট যোগে টেকনাফ যাওয়া যায়।
কম খরচে যাওয়ার জন্য কক্সবাজার বাস টার্মিনাল থেকে টেকনাফের উদ্দেশ্যে বিরতিহীন পালকি নামক বাস চলাচল করে, জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। সিএনজি জনপ্রতি ভাড়া ৩০০ টাকা। এই গাড়ি গুলো মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে চলাচল করে।
এছাড়া পর্যটকবাহী গাড়ি “নীল দরিয়া” মেরিন ড্রাইভ দিয়ে চলাচল করে, জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। এছাড়া ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সরাসরি এসি ও ননএসি বাস টেকনাফ চলাচল করে।
টেকনাফ কোথায় থাকবেন?
টেকনাফ পৌরসভা এলাকায় পর্যটকদের সুলভে থাকার জন্য বেশ কিছু হোটেল রয়েছে। এই হোটেল গুলোর নাম, ঠিকানা নিচে উল্লেখ করা হয়েছে।
- সেন্ট্রাল রিসোর্ট: মেরিন ড্রাইভ সড়ক, টেকনাফ। মোবাইল নাম্বার 01838-379372.
- আলো রিসোর্ট: মূল সড়ক, টেকনাফ। মোবাইল নাম্বার 01709-399191.
- সী কোরাল রিসোর্ট: মূল সড়ক, টেকনাফ। মোবাইল নাম্বার 01811-564750
- হোটেল নেটং, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন: কিরণতলী, টেকনাফ। মোবাইল নাম্বার 01991-139219
টেকনাফ কোথায় খাওয়া দাওয়া করবেন?
টেকনাফ পৌরসভা এলাকায় খাওয়া-দাওয়া করার জন্য ভালো মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আপনারা সেখান থেকে খাওয়া-দাওয়া করতে পারবেন।
FAQ (প্রশ্ন উত্তর)
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ কত কিলোমিটার?
কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোড ৮০ কিলোমিটার।
চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ কত কিলোমিটার?
সড়ক পথে চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ ২২০ কিলোমিটার, যেতে সময় লাগবে আনুমানিক ৬ ঘন্টা।
টেকনাফ কিসের জন্য বিখ্যাত?
বাংলাদেশের সর্ব-দক্ষিণের শেষ উপজেলা টেকনাফ। টেকনাফ তার মনোরম সমুদ্র সৈকত, ঐতিহাসিক স্থান, ম্যানগ্রোভ বন এবং স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত।