নীলাদ্রি লেক, সুনামগঞ্জ – যাতায়াত, ভ্রমণ খরচ ও ট্যুর প্লান
নীলাদ্রি লেক (Niladri lake) সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টেকেরঘাট গ্রামে অবস্থিত। মূলত এই লেকটি চুনাপাথরের পরিত্যাক্ত খনির লাইম স্টোন লেক। এই লেকের প্রকৃতি নাম শহীদ সিরাজ লেক।
স্থানীয় মানুষের কাছে এই লেক টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি নামে পরিচিত। কিন্তু ভ্রমণ কমিউনিটিতে এই লেক নীলাদ্রি নামে পরিচিত। লেকের নীল জলরাশী, ছোট বড় টিলা ও উঁচু পাহাড়ের সমন্বয় এই লেকের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। অনেকেই এর অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে বাংলার কাশ্মীর হিসাবে অভিহিত করেছেন।
লেকের নীল জলে নৌকায় ঘুরে বেড়াতে পারবেন এবং কায়াকিং করতে পারবেন। যারা ছবি তুলতে পছন্দ করেন তাদের জন্য নীলাদ্রি লেক আদর্শ স্থান। লেকের পাশে টিলা রয়েছে, সেখানে সবুজ ঘাসের উপর বসে ছবি তুলতে পারবেন। এছাড়া উত্তর পাশের টিলায় গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন।
১৯৪০ সালে টেকেরঘাট এই পাথর কোয়ারি থেকে প্রথম চুনাপাথর উত্তোলন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর চুনাপাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৬৬ সালে আবার নতুন করে চুনাপাথর উত্তোলন শুরু হলেও ১৯৯৬ লোকসনের কারণে উত্তলন বন্ধ করা হয়।
নীলাদ্রি লেক যাওয়ার উপযুক্ত সময়
নীলাদ্রি লেক বছরের যেকোনো সময় ঘুরতে আনতে পারেন। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। কারণ বর্ষাকাল হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। তাই ইংরেজি জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে আসুন।
এছাড়া যারা হাওরে অতিথি পাখি দেখতে চান তারা শীতের মৌসুমে যেতে পারেন। শীতের সময় এখানে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে।
নীলাদ্রি লেক কিভাবে যাবেন
নীলাদ্রি লেক যেতে চাইলে সুনামগঞ্জ আসতে হবে। ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে খুব সহজে সুনামগঞ্জ আসতে পারবেন।
ঢাকার সায়েদাবাদ, গাবতলী, ফকিরাপুল, আব্দুল্লাহপুর থেকে মামুন, এনা, শ্যামলী, হানিফ, গ্রীন লাইন, এস আলম সোহাগ পরিবহন সহ আরো বিভিন্ন পরিবহনের এসি / নন-এসি বাস নিয়মিত চলাচল করে।
এসি/নন-এসি বাস ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৭০০ টাকা থেকে ১,৩০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ বাসে যেতে সময় লাগবে ৬ ঘন্টা।
ঢাকা থেকে ট্রেনে সুনামগঞ্জ যেতে ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সিলেটগামী যেকোনো ট্রেনে চড়ে সিলেট যাবেন। সিলেটের কুমারগাও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জগামী বিরতিহীন বাসে চড়ে জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে সুনামগঞ্জ যেতে পারবেন। যেতে সময় লাগবে ২ ঘন্টা।
সুনামগঞ্জ শহরের নতুন ব্রীজ থেকে টেকেরঘাট যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল পেয়ে যাবেন। মোটরসাইকেল রিজার্ভ নিলে ভাড়া লাগবে ৪০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা। একটি মোটরসাইকেলে দুই জন যেতে পারবেন। যাত্রাপথে যাদুকাটা নদী পার হতে হবে জনপ্রতি ৫ টাকা এবং মোটরসাইকেল ১০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
বর্ষা মৌসুমে সুনামগঞ্জ শহর থেকে অটোরিকশা বা সিএনজি ভাড়া করে তাহিরপুর বাজারে চলে আসবেন। সেখান থেকে রিজার্ভ নৌকা ভাড়া নিয়ে সরাসরি নীলাদ্রি লেকে আসতে পারবেন।
এছাড়া ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রত্যেক দিন রাত ১১ টায় মোহনগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে মোহনগঞ্জ রেলস্টেশন নেমে যাবেন। সেখান থেকে অটোরিকশা করে চলে যাবেন মধ্যনগর বাজার। মধ্যনগর বাজার থেকে সিএনজি করে নীলাদ্রি লেক আনতে পারবেন।
কোথায় খাবেন
লেকের আশেপাশে খাবার জন্য তেমন ভালো মানের হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। বারিক্কা টিলায় খাবার জন্য সাধারণ মানের কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এছাড়া বড়ছড়া বাজার ও টেকেরঘাট ছোট বাজারে খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেখান থেকে খাবার খেতে পারবেন।
এছাড়া ভালো মানের খাবার খেতে চাইলে সুনামগঞ্জ শহরে আসতে হবে। সেখানে খাবার জন্য আধুনিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেখান থেকে নিজের পছন্দসই খাবার খেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
নীলাদ্রি লেকের পাশে থাকার জন্য ভালো মানের কোনো হোটেল নেই। বড়ছড়া বাজার ও তাহিরপুর বাজারে থাকার জন্য ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে হোটেল ও গেস্ট হাউজ পাবেন। চাইলে লেকের পাশে পুরাতন চুনাপাথর কারখানার গেস্ট হাউজে থাকতে পারবেন।
এছাড়া বর্ষা মৌসুমে যারা এখানে ঘুরতে আসে তারা হাউজ বোডে রাত্রিযাপন করে। হাওরে ঘোরার জন্য প্রিমিয়াম মানের অনেক হাউজ রয়েছে।
এছাড়া ভালো মানের হোটেলে রাত্রিযাপন করতে চাইলে সুনামগঞ্জ শহরে আসতে হবে। সেখানে ১,০০০ টাকা থেকে ৪,০০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের হোটেল পাবেন।
ট্যুর প্লান
যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, নীলাদ্রি লেক, বারিক্কা টিলা এবং টাঙ্গুয়ার হাওর সবগুলো ট্যুরিস্ট স্পটে খুবই কাছাকাছি। তাই আপনার হাতে সময় নিয়ে একে একে সবগুলো ট্যুরিস্ট স্পট দেখে আসতে পারেন। বর্ষা মৌসুমে হাউজ বোডে করে এক খরচে সবগুলো স্পট দেখে আসতে পারবেন।
শুকনো মৌসুমে ডে ট্রিপে একদিকে সুনামগঞ্জের সবগুলো ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে দেখে আসতে পারবেন। এজন্য সুনামগঞ্জ শহর থেকে রিজার্ভ মোটরসাইকেল ভাড়া করে যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, নীলাদ্রি লেক ও বারিক্কা টিলা ঘুরে আবার সুনামগঞ্জে ফিরে আসতে পারবেন।
সারা দিনের জন্য মোটরসাইকেল ভাড়া লাগবে ১,২০০ টাকা থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত। একটি মোটরসাইকেল দুইজন ব্যাক্তি যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আপনাকে খরচ অনেকটা কমে যাবে। তাই গ্রুপ ট্যুর দিলে খরচ কমে যায়।
ভ্রমণ টিপস
- লেকের গভীরতা অনেক বেশি তাই সাঁতার না জানলে লেকে নামবেন না (প্রয়োজনে লাইফ জ্যাকেট পড়ুন)।
- লেকের জলে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।
- কোনোকিছু কেনাকাটা করার আগে দামাদামি করে নিবেন।
- স্থানীয় মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
- লেকে কায়াকিং করার সময় অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করুন।
- খরচ কমাতে গ্রুপ ট্যুর করুন।
আশেপাশে দর্শনীয় স্থান সমূহ
নীলাদ্রি (শহীদ সিরাজ) লেক ঘুরতে গিয়ে আশেপাশে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। হাতে সময় নিয়ে সেখান থেকে ঘুরে আসবেন। দর্শনীয় স্থানগুলো মধ্যে যাদুকাটা নদী, শিমুল বাগান, বারিক্কা টিলা ও টাঙ্গুয়ার হাওর উল্লেখযোগ্য।