বর্তমানে বাংলাদেশীদের পাকিস্তান ভ্রমণে আগ্রহ বাড়ার অন্যতম একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভ্রমণ ব্যায় কম, সংস্কৃতির ভিন্নতা ও ভিসা প্রক্রিয়া সহজলভ্যতা। বর্তমানে পাকিস্তান ভ্রমণে ঝুঁকছেন বাংলাদেশী তরুণ পর্যটক ও অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা। সাম্প্রতিক সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান ভ্রমণ খরচ ও দারুণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন তারা। তার সাথে তুলে ধরেছে পাকিস্তানের নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক।
আজকের আর্টিকেলে আমরা জানবো বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান ভ্রমণ খরচ, ভিসা প্রসেসিং, কারেন্সি চেঞ্জি, কোথায় থাকবেন, খাওয়া-দাওয়া, পাকিস্তানের দর্শনীয় ট্যুরিস্ট স্পট কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবেন সহ বিস্তারিত ভ্রমণ তথ্য।
পাকিস্তান ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
পাকিস্তান ভ্রমণের উপযুক্ত সময় নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। তবে এসময় পাকিস্তানের হুনজা বা স্কার্দু যাওয়া বেশ কঠিন। কারণ শীতকাল হওয়ায় রাস্তায় বরফ জমে থাকে। তবে শীতকালে সোয়াত ট্যুর করে অনেক মজা পাবেন।
পাকিস্তান ট্যুরের অফ সিজন হলো মে মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। যারা কম খরচে পাকিস্তান ট্যুর করতে চান তারা এই অফ সিজনে ট্যুর করলে কম খরচে ট্যুর করতে পারবেন। এসময় ট্যুরিস্ট স্পটে গাড়ি ভাড়া, হোটেল ভাড়া অনেক কম থাকে।
পাকিস্তান ভিসা আবেদন
পাকিস্তানের ভ্রমণ করার জন্য প্রথমে আপনাকে অনলাইনে ভিসা আবেদন করতে হবে। নিজের কম্পিউটার বা বাজারের কম্পিউটার থেকে অনলাইনে পাকিস্তান ট্যুরিস্ট ভিসার আবেদন করতে পারবেন।
আবেদন ফি ২৫ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় ৩,০০০ টাকার একটু বেশি। আবেদন করার ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ভিসা পেয়ে যাবেন। বর্তমানে বাংলাদেশ পাকিস্তান দুই দেশ ভিসা প্রসেসিং সহজ করার জন্য কাজ করছে।
বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান বিমান ভাড়া
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান সরাসরি ফ্লাইট নেই। তাই আপনাকে ওয়ান স্টপ ফ্লাইটে পাকিস্তান যেতে হবে। দুই দেশের মধ্যে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট চালু হবে। বাংলাদেশ থেকে লাহোর বিমান ভাড়া ৪২,০০০ থেকে ৪৫,০০০ টাকা।
ঢাকা টু করাচী ও ইসলামাবাদ বিমান ভাড়া অনেক বেশি তাই কম খরচে যাওয়ার জন্য আপনি লাহোর বিমানবন্দর যাবেন। লাহোর থেকে বাসে চড়ে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ যেতে হবে। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে বাস বা ট্যাক্সি পাবেন। যেতে সময় লাগবে ৫ ঘন্টা, ভাড়া লাগবে ১,০০০ টাকার মতো।
মানি এক্সচেঞ্জ
লাহোরে পৌঁছে বিমানবন্দর মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার থেকে বাংলাদেশি টাকাকে রুপিতে কনভার্ট করে নিবেন। বর্তমান রেট অনুযায়ী বাংলাদেশের ১০০ টাকার বিনিময়ে পাকিস্তানি ২৩১ রুটি পাবেন। টাকার মান সময় কম বেশি হয়ে থাকে।
এছাড়া আপনি চাইলে পাকিস্তানের যেকোনো ব্যাংক থেকে মানি এক্সচেঞ্জ করে নিতে পারেন। মনে রাখবেন কনভার্টের সময় আপনাকে কিছুটা কম দিবে।
পাকিস্তানী সিম কেনার উপায়
লাহোর বিমানবন্দর থেকে পাসপোর্ট শো করে খুব সহজে ট্যুরিস্ট সিম কিনতে পারবেন। বাহির থেকে সিম কিনতে ঝামেলার পড়বেন তাই বিমানবন্দর থেকে সিম কিনবেন। চেষ্টা করবেন Zong বা Jazz সিম কেনার। কারণ এই সিমে পাকিস্তানের যেকোনো স্থানে ভালো ইন্টারনেট সার্ভিস পাবেন।
এছাড়া আপনার যদি পাকিস্তানী কোনো পরিচিত লোক থাকে তাহলে তার মাধ্যমে সিম ক্রয় করতে পারেন। পাকিস্তানে আপনি যেখানে যান না কেন আপনার অবশ্যই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে।
কোথায় থাকবেন (হোটেল বুকিং)
পাকিস্তানের যেকোনো প্রদেশে (ইসলামাবাদ, করাচী, লাহোর) থাকার জন্য ১,০০০ থেকে ১,৫০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের হোটেল পাবেন। হোটেলের সাথে বিনামূল্যে সকালের নাস্তা পাবেন।
পাকিস্তানের সব প্রদেশে থাকার জন্য হোটেল পাবেন। বিশেষ করে হুনজা ও সোয়াতে হোটেলের সংখ্যা অনেক বেশি। অফ সিজনে ভালো মানের সিঙ্গেল রুম ৭০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন। আপনার পছন্দ ও বাজেটের মধ্যে রুম ভাড়া নিবেন।
এসব হোটেলের সিঙ্গেল রুম গুলোতে ২ থেকে ৩ জন এবং ডাবল রুম গুলোতে ৪ থেকে ৬ জন থাকতে পারবেন। অগ্রিম হোটেল রুম বুকিং করতে booking.com মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ভিজিট করুন।
এছাড়া ৫-৬ মিলে ক্যাম্পিং করে থাকতে পারেন। তবে লোকালয়ের কাছে নিরিবিলি পরিবেশে ক্যাম্পিং করতে পারেন। অনেক বিদেশি ট্রাভেলারকে দেখছি পাকিস্তান ভ্রমণে গিয়ে এভাবে থাকতে। এতে আপনার খরচ অনেক কমে যাবে। তবে শীতকালে এই কাজ করবেন না। কারণ এসব অঞ্চলে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে, রাস্তায় বরফ জমে যায়।
যাতায়াতের ব্যবস্থা ও খরচ
আপনার ভ্রমণ শুরু হবে রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে। ইসলামাবাদ থেকে খুব সহজে খাইবার পাখতুনখা, গিলগিট-বাল্টিস্তান, আজাদ কাশ্মীর সহ যেকোনো স্থানে ভ্রমণ করতে পারবেন।
পাকিস্তানের উত্তর প্রদেশ ভ্রমণ করার জন্য ইসলামাবাদ থেকে একটি রিজার্ভ গাড়ি ভাড়া নেওয়া ভালো। কারণ গিলগিট-বাল্টিস্তান এলাকায় ভাড়ায় গাড়ি কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ভেঙে ভেঙে ভ্রমণ করা অনেক কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ।
রিজার্ভ গাড়ি ভাড়া নিলে সব টেনশন শেষ। আপনি কোন কোন ট্যুরিস্ট স্পট যেতে চাচ্ছেন ড্রাইভারকে বললে নিয়ে যাবে। সারা দিনের জন্য একটি গাড়ি ভাড়া ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ টাকা। ৪-৫ জন মিলে একটি গাড়ি ভাড়া নিলে খরচ কম হবে।
১০-১২ জনের জনের বড় একটি গ্রুপ মিলে মাইক্রো বাস ভাড়া নিলে খরচ অনেক কম হবে। তাই চেষ্টা করবেন গ্রুপ যত বড় হবে খরচ ততই কম হবে। পাকিস্তানে থাকা-খাওয়া ও অভ্যন্তরিন যাতায়াত খরচ আমাদের বাংলাদেশের মতো। তাই যে কয়দিন থাকুন না কেন বেশি টাকা খরচ হবে না। বড় খরচ হলো বিমান ভাড়া।
পাকিস্তান ভ্রমণ খরচ
- ভিসা আবেদন খরচ ৩,০০০ টাকা।
- ঢাকা টু লাহোর বিমান ভাড়া ৪১,০০০ থেকে ৪৫,০০০ টাকা।
- লাহোর টু ইসলামাবাদ (যাওয়া-আসা) বাস ভাড়া ২,০০০ টাকা।
- পাকিস্তানে ১৫-২০ দিন থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, ঘোরাঘুরি আরো ১৫,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা।
- সর্বমোট খরচ প্রায় ৬৫,০০০ থেকে ৭০,০০০ টাকা।
এটা হচ্ছে ১ জনের হিসাব। আপনি যখন ৫-৬ জনের গ্রুপের সাথে পাকিস্তান ভ্রমণে যাবেন তখন আপনার খরচ অনেক কমে যাবে। তখন আপনার মোট খরচ হবে ৬০,০০০ টাকার মধ্যে। আপনার ব্যাক্তিগত কেনাকাটা হিসাব আলাদা।
পাকিস্তানের কোথায় কোথায় ঘুরবেন
পাকিস্তানে ঘুরবার জন্য প্রচুর ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের উত্তর প্রদেশ ঘুরার জায়গায় অভাব নেই। আপনি একটানা ১ বছর ঘুরলেও স্বাদ মিটবে না। যেহেতু আমাদের এতো ঘুরার সময় ও সামর্থ নেই তাই উল্লেখযেগ্য দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখবো।
- সোয়াত – কামাল ভ্যালি, কামরাট ভ্যালি, মহোদন্ড লেক, কুন্ডোল লেক, মালুম জাব্বা রিসোর্ট ইত্যাদি।
- হুনজা – হুনজা ভ্যালি, বালতিত ফোর্ট, আলতিত ফোর্ট, মাউন্ট রকাপুসি, আতাবাদ লেক ইত্যাদি।
- স্কার্দু – স্কার্দু সিটি, আপার কাচুরা লেক, লোয়ার কাচুরা লেক, সার্ফারাঙ্গা কোল্ড ডেজার্ট, সাতপারা লেক ইত্যাদি।
- আজাদ কাশ্মীর – নীলাম ভ্যালী, মুজাফফরাবাদ সিটি, চিত্তকথা লেক, রাত্তি-গালি লেক ইত্যাদি।
উপরে উল্লেখ করা ট্যুরিস্ট স্পট গুলো অনেক জনপ্রিয়। মনে রাখবেন এগুলো ছোটখাটো কোনো ট্যুরিস্ট স্পট না। এগুলো বাংলাদেশের ২ থেকে ৩ টা জেলার সমান বড়। এর মধ্যে আরো অনেক ছোট ছোট ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে।
সোয়াত, স্কার্দু ও হুনজা অঞ্চলে যেতে হলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম সড়ক “কারাকোরাম হাইওয়ে” দিয়ে যেতে হবে। এই হাইওয়ে দিয়ে ছাদ খোলা জীপে যাওয়ার অনুভূতি সারাজীবন মনে রাখার মতো।
হুনজায় যেতে “বাবুসর পাস” হাইওয়ে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু সড়ক, সেখানে আপনানে মেঘের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে। আপনি মেঘ ছুয়ে দেখতে পাবেন। আর “পাসু কোন” সড়কে গেলে আপনার মনে হবে পাহাড়ি রাস্তা যেন শেষ হয় না।
আজাদ কাশ্মীর যেতে হয় “পীর চিনসি” রোড দিয়ে। এই রোড়ে মেঘের ওড়াউড়ি দেখতে পাবেন, ইচ্ছে করলে মেঘ ছুয়ে দেখতে পারবেন। মাঝে মাঝে বরফে সড়ক বন্ধ থাকে।
বি:দ্রি: – পাকিস্তানে পর্যটকদের নিরাপত্তা, সহায়তা ও প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়ার জন্য সকল ট্যুরিস্ট স্পটে সরকারি ট্যুরিস্ট তথ্য সেন্টার রয়েছে। সেখানে আপনার সুবিধা-অসুবিধা জানতে পারেন।