alternatetext
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর
|

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর – যাতায়াত, থাকা-খাওয়া খরচ ও পরামর্শ

সিলেট জেলার ভারত সীমান্তবর্তী কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রাম ভোলাগঞ্জ। প্রকৃতি মোড়ানো ভোলাগঞ্জ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি। যা পর্যটকদের কাছে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ট্যুরিস্ট স্পট নামে পরিচিত। বর্তমানে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এই ট্যুরিস্ট স্পটটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

যতদূর চোখ যায় চোখে মিলবে সাদা পাথর, মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জলরাশী, মেঘালয়ের সবুজ পাহাড় ও মেঘের আলিংগড়। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে মনে আপনি স্বর্গের কোনো রাজ্যে আছেন।

ভোলাগঞ্জের ভারতীয় সীমান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় গুলো। মেঘালয়ের এই পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে নেমে আসা পানিতে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তার নাম ধলাই নদ। বর্ষা আর পাহাড়ী ঝর্ণার পানির স্রোতে ধলাই নদীতে সাদা পাথর নেমে আসে।

ধলাই নদের উৎস মুখের পাথর পরিবেষ্টিত জায়গাটুকু ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট বা ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর নামে পরিচিত। এই জায়গাটুকু দেখতে ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে চারপাশে ঘুরে আবার মিলিত হয়েছে।

BM Khalid Hasan Sujon

ধলাই নদের পানির স্রোতের সাথে ভারত সীমান্তের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে প্রচুর পাথর নেমে আসে। এখান থেকে স্থানীয় লোকেরা প্রতিদিন পাথার উত্তলন করে। আরো সহজে পাথর উত্তলন করতে ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে নির্মাণ করা হয়।

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এই রোপওয়ে ব্যবহার করা হয়। ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ এই রোপওয়ে। বর্তমানে এই রোপওয়ে গুলো অতিতের স্মৃতি চিহ্ন হয়ে রয়েছে।

রোপওয়ে বন্ধ হলেও স্থানীয় লোকেরা প্রতিদিন এখান থেকে জীবিকার তাগিদে পাথর উত্তোলন করে। ১০ নং ঘাট থেকে নৌকায় চড়ে সাদা পাথর যাওয়ার পথে স্থানীয় মানুষের ছোট নৌকা নিয়ে পাথর তোলার দৃশ্য দেখতে পাবেন।

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকার কাছেই রয়েছে উৎমাছড়া, তুরুংছড়ার মতো আরো দুইটি পর্যটন স্থান। সাদা পাথর ট্যুরিস্ট স্পটে বেড়াতে গিয়ে এই দুইটি পর্যটন স্পট থেকে অবশ্যই ঘুরে আসবেন।

BM Khalid Hasan Sujon

ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

ভোলাগঞ্জ সিলেট বেড়াতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল বা বর্ষাকালের ১-২ মাস পর। অর্থাৎ ইংরেজি জুন থেকে ডিসেম্বর মাস। আপনি যদি বছরের অন্যান্য সময় বেড়াতে আসতে চান তাহলে ভোলাগঞ্জের আসল সৌন্দর্য দেখতে পারবেন না।

বর্ষাকালে মেঘালয় পাহাড় চির সবুজ থাকে, ঝর্ণা ও ধলাই নদীতে পানি পাথে। কিন্তু অন্য সময় ভোলাগঞ্জ পাথর দেখতে পাবেন কিন্তু নদীতে পানির পরিমান কম থাকে।

ভোলাগঞ্জ কিভাবে যাবেন

ভোলাগঞ্জ আসতে হলে প্রথমে আপনাকে সিলেট আসতে হবে। সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব ৩৪.৩ কিলোমিটার। সিলেটের আম্বরখানা ও মজুমদারী এলাকা থেকে ভোলাগঞ্জ যাওয়ার জন্য সিএনজি, প্রাইভেট কার, ট্যুরিস্ট বাস, লোকাল বাস ও বিআরটিসি বাস পাওয়া যায়।

BM Khalid Hasan Sujon

বাসে ঢাকা থেকে সিলেট: ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী, গ্রীন লাইন, হানিফ, সোগান, এনা পরিবহন সহ সিলেটগামী যেকোনো পরিবহনে করে সিলেট যেতে পারবেন। এসি/নন-এসি বাস ভেদে ভাড়া ৭০০ থেকে ১,৫০০ টাকা। বাসে যেতে সময় লাগে ৬-৭ ঘন্টা।

ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেট: ঢাকার কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে উপবন, কালনী, জয়ন্তিকা ও পারাবত এক্সপ্রেস করে সিলেট যেতে পারবেন। সিট ক্লাস ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৩৭৫ থেকে ১,২৮৮ টাকা।

বিমানে ঢাকা টু সিলেট: ঢাকার হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর যেতে পারবেন। ঢাকা টু সিলেট বিমান ভাড়া ৪,৪০০ টাকা। যেতে সময় লাগবে ৫৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা।

চট্টগ্রাম থেকে সিলেট: চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ট্রেন। চট্টগ্রাম থেকে উদায়ন ও পাহাড়িকা এক্সপ্রেস নামে দুইটি ট্রেন সিলেট যায়। সিট ক্লাস ভেদে ভাড়া ৪৫০ থেকে ১,৫৪১ টাকা। ট্রেনের টিকেট বুকিং করতে ভিজিট করুন https://eticket.railway.gov.bd/

সিলেট শহর থেকে ভোলাগঞ্জ

সিলেটের মজুমদার ও আম্বরখানা থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যাওয়ার জন্য সিএনজি, প্রাইভেট কার, লোকাল বাস, ট্যুরিস্ট বাস ও বিআরটিসি বাস পাওয়া যায়। সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত প্রতি ২০ মিনিট পরপর বাস ছেড়ে যায়।

বাসে সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ৭০ টাকা। লোকাল সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া ১৫০-১৬০ টাকা। সিএনজি রিজার্ভ নিলে ভাড়া লাগবে ১,৩০০-১,৫০০ টাকা। একটি সিএনজিতে ৫-৬ জন যেতে পারবেন। যেতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টা মতো।

প্রাইভেট কার রিজার্ভ ভাড়া নিয়ে সরাসরি ভোলাগঞ্জ ১০ নং নৌকা ঘাট পর্যন্ত যেতে পারবেন। প্রাইভেট কার রিজার্ভ ভাড়া লাগবে ২,৮০০-৩,০০০ টাকা পর্যন্ত।

ভোলাগঞ্জ নেমে ১০ নং নৌকা ঘাট থেকে সাদা পাথর যাওয়ার জন্য নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। যাওয়া আসা নৌকা ভাড়া লাগবে ৮০০ টাকা। প্রতি নৌকায় ৮ জন যেতে পারবেন।

এছাড়া সিলেট শহর থেকে সিএনজি, লেগুনা বা প্রাইভেট কার নিয়ে কোম্পানিগঞ্জের টুকের বাজার হয়ে ভোলাগঞ্জ যেতে পারবেন। সিলেট শহর থেকে টুকের বাজার জনপ্রতি সিএনজি ভাড়া ২৫০ টাকা। টুকের বাজার থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর জিরো পয়েন্ট যেতে পারবেন। বর্ষাকালে নৌকায় করে ছাতক হয়ে ভোলাগঞ্জ যেতে পারবেন।

উৎমাছড়া ও তুরংছড়া

ভোলাগঞ্জের পাশে উৎমাছড়া ও তুরংছড়া নামে আরো দুইটি ট্যুরিস্ট স্পট রয়েছে। ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ঘুরতে গিয়ে হাতে সময় নিয়ে উৎমাছড়া ও তুরংছড়া ঘুরে আসবেন। ভোলাগঞ্জ থেকে উৎমাছড়া ও তুরংছড়া যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে দয়ারবাজার যেতে হবে।

আপনি ভোলাগঞ্জ থেকে যে নৌকায় সাদা পাথর যাবেন ঔ নৌকায় দয়ারবাজার ঘাটে যেতে পারবেন। সেক্ষেত্রে নৌকার মাঝিকে আগেই বলে নিবেন এবং এরজন্য কিছু টাকা বাড়িয়ে দিতে হবে।

দয়ারবাজার থেকে মোটরসাইকেল বা সিএনজি করে ৩০ থেকে ৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে চরার বাজার যাবেন। চরার বাজার নেমে স্থানীয় কাউকে জিজ্ঞেস করলে উৎমাছড়া ট্যুরিস্ট পয়েন্ট যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিবে। ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলে উৎমাছড়া পৌঁছে যাবেন।

আবার চরার বাজার থেকে তুরংছড়া হেঁটে যেতে প্রায় আধাঘন্টা সময় লাগে। যদি সম্ভব হয় তাহলে মোটরসাইকেল করে যেতে পারবেন। চরার বাজার থেকে সিলেট শহরে ফেরার সময় সিএনজি করে সরাসরি আসতে পারবেন।

কোথায় খাবেন

ভোলাগঞ্জ ১০ নং নৌকা ঘাটে দেশি খাবার খাওয়ার জন্য সাধারণ মানের খাবার হোটেল রয়েছে কিন্তু ভালো মানের খাবার হোটেল নেই। এখানে সাদা ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, ভর্তা, সবজি খেতে পারবেন। 

ভোলাগঞ্জ যাওয়ার পথে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা শহরে মোটামুটি মানের বেশ কয়েকটি খাবার হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল আলম হোটেল, দেশবন্ধু রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য। এছাড়া টুকের বাজারে মায়া রেস্টুরেন্ট, নবীন রেস্টুরেন্ট উল্লেখযোগ্য।

চাইলে সিলেট শহর থেকে সকালের নাস্তা করে সারা দিন ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে সন্ধ্যায় সিলেট শহরে ফিরে এসে রাতের খাবার খেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

ভোলাগঞ্জ ও কোম্পানিগঞ্জ থাকার জন্য ভালো মানের আবাসিক হোটেল নেই। অধিকাংশ পর্যটকেরা সকালে সিলেট শহর থেকে নাস্তা করে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর যায়, সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় আবার সিলেট শহরে ফিরে এসে রাত্রিযাপন করে।

কোনো কারণে যদি ভোলাগঞ্জ থাকতে চান তাহলে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা শহরে যেতে হবে। কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা শহরে থাকার জন্য মোটামুটি মানের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল ও বোডিং রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল আল হাসান, বাদশা বোডিং, হালিমা বোডিং, হোটেল আল সাদিক উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জেলা পরিষদের একটি ডাকবাংলো রয়েছে। অনুমতি নিয়ে সেখানে থাকতে পারবেন।

সিলেট শহরের লালাবাজার ও দরগা রোড় এলাকায় কম টাকায় থাকার জন্য অনেক আবাসিক হোটেল পাবেন। সেখানে ৭০০ থেকে ২,৫০০ টাকার মধ্যে এসি/নন-এসি রুম পেয়ে যাবেন।

ভোলাগঞ্জ ভ্রমণ পরামর্শ

  • ভোলাগঞ্জ ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল বা বর্ষাকালের ১-২ মাস পরে।
  • একদিনে সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ, উৎমাছড়া ও তুরংছড়া ভ্রমণে যেতে চাইলে সকাল সকাল রওনা দিবেন।
  • সিলেটের আম্বরখানা থেকে রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া করে নেওয়া ভালো, তবে খরচ একটু বেশি।
  • যানবাহন, হোটেল ভাড়া, খাওয়া-দাওয়া সহ সকল বিষয় দামাদামি করে নিবেন।
  • কম খরচে ট্যুর প্ল্যান করতে চাইলে গ্রুপ করে ঘুরতে যাবে।
  • সাদা পাথর কত সময় থাকবেন নৌকার মাঝিকে আগেই বলে নিবেন।
  • সব সময় চেষ্টা করবেন সন্ধ্যার আগে সিলেট শহরে ফিরে আসতে।
  • ভোলাগঞ্জ ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চল তাই সাবধানে চলাচল করবেন।
  • বর্ষাকালে ধলাই নদীতে অনেক স্রোত থাকে, তাই বেশি পানিতে নামবেন না।
  • পরিবেশ ও প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবেন না।
  • স্থানীয় মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।

আশেপাশে আরো দর্শনীয় স্থান

সিলেট ভোলাগঞ্জ ছাড়াও আশেপাশে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে জাফলং, লালাখাল, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, শাপলা বিল, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, রাংপানি উল্লেখযোগ্য।

আরো পড়ুন

Similar Posts