মেরিন ড্রাইভ রোড, কক্সবাজার
কক্সবাজার ভ্রমণের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান হল বিশ্বের দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ রোড (Marin drive road). কক্সবাজার কলাতলী থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের শেষ সীমানা টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। মেরিন ড্রাইভ ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রোড বা সড়ক।
এই রোড়ের একপাশে বিশাল দিগন্ত সমুদ্র সৈকত এবং অন্য পাশে রয়েছে সবুজে ঘেরা ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড়ের কোথাও কোথাও দেখতে পাবেন ঝর্ণা। যারা একসাথে পাহাড় ও সমুদ্র দেখতে চান তারা মেরিন ড্রাইভ রোড কক্সবাজার ভ্রমণ করুন।
এই রোড়ের পাশে রয়েছে চোখ ধাধানো মনোরম দৃশ্য যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এই রোড় দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পাবেন বিস্তৃত সমুদ্র, জেলেদের মাছ ধরার নৌকা (সাম্পান), মাছ ধরার দৃশ্য, উঁচু উঁচু পাহাড়, পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণার ধারা।
কক্সবাজার কলাতলী বা সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে মাইক্রোবাস, সিএনজি বা খোলা জিপে করে মেরিন ড্রাইভ রোড ঘুরে দেখতে পাবেন। এই রোড দিয়ে হিমছড়ি ঝর্ণা ও পাহাড়, ইনানী বিচ, লাল কাঁকড়ার বিচ, দরিয়ানগর যাওয়া যায়।
মেরিন ড্রাইভ সড়ক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ হলেও পর্যটকেরা যেতে ক্লান্ত হয় না। কারণ সড়কের দুইপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ক্লান্তি দুর হয়ে যায়। মেরিন ড্রাইভ রোডের দুইপাশে অনেক রেস্তোরাঁ রয়েছে, সেখানে বসে একটু বিশ্রাম নিতে পারবেন।
এই রোডে কোনো ভারী পরিবহন চলাচল করে না। শুধুমাত্র পর্যটকদের জন্য পর্যটন বাস, ছাদ খোলা জিপ গাড়ি, সিএনজি বা অটোরিকশা চলাচল করে।এতে পর্যটকেরা ১ থেকে দেড় ঘন্টা যাতায়াতে সুবিধা পাচ্ছে।
১৯৮৯ সালে মেরিন ড্রাইভ রোড নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে ৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ প্রকল্প গ্রহণ করের তৎকালীন সরকার। তবে ২ কিলোমিটার রোড নির্মান করার পর এই কাজ বন্ধ হয়ে যায় সমুদ্রের প্রবল স্রোতের কারণে।
এরপর ১৯৯৫ সালে এই রোডের নির্মাণ কাজ পুনরায় আরম্ভ হয়। তখন এই নির্মাণ কাজের দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। মাঝে কয়েক বছর কাজ বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে পুনরায় আবার মেরিন ড্রাইভ রোডের কাজ আরম্ভ হয়।
বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে এই রোডের নির্মাণ কাজ পরিচালনা করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। তিন ধাপে মেরিন ড্রাইভ রোডের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
প্রথম ধাপে কক্সবাজারের কলাতলী বিচ থেকে ইনানী বিচ পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার, দ্বিতীয় ধাপে শিলখালী থেকে টেকনাফ সদর পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার এবং তৃতীয় ধাপে টেকনাফ থেকে সাবরাং পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার।
মেরিন ড্রাইভ রোড তৈরিতে মোট খরচ হয় প্রায় ৪৫৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১ বছর আগে ২০১৭ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
২০১৭ সালের ৬ মে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেরিন ড্রাইভ রোড শুভ উদ্বোধন করেন। এরপর থেকে পর্যটক ও জনসাধারণের জন্য রোডটি উন্মুক্ত করা হয়।
মেরিন ড্রাইভ ভ্রমণ করার সময় পথে কয়েক জায়গায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট পড়বে। সেখানে বিনা সংকোচে নিজের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে তাদের সহযোগিতা করবেন। ঝামেলা এড়াতে নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র বা ফটোকপি সাথে রাখবেন।
মেরিন ড্রাইভ কি
মেরিন ড্রাইভ হল বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার সমুদ্র সৈকতের পাশ ঘেঁসে একটি রাস্তার নাম। মেরিন ড্রাইভ কক্সবাজার থেকে টেকনাফ ৮০ কিলোমিটার একটি রোড বা সড়ক।
বর্তমানে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘতম মেরিন ড্রাইভ রোড বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে টেকনাফ। এর এক পাশে নীল দিগন্ত সমুদ্র সৈকত এবং অপর পাশে ছোট-বড় সবুজ পাহাড়।
কিভাবে মেরিন ড্রাইভ রোড যাবেন
মেরিন ড্রাইভ রোড ভ্রমণ করতে হলে আপনাকে প্রথমে কক্সবাজার আসতে পারবেন। ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম (বাস, ট্রেন, বিমান) রয়েছে। যেকোনো একটি মাধ্যম ব্যবহার ঢাকা থেকে কক্সবাজার আসতে পারবেন।
ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ, আব্দুল্লাহপুর, ফকিরাপুল বাস টার্মিনাল থেকে শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ, গ্রীন লাইন, সেন্টমার্টিন, মডার্ন লাইন, সৌদিয়া, এস আলম পরিবহন ইত্যাদি বাস প্রতিদিন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
এসি, নন-এসি বাস ভেদে ঢাকা টু কক্সবাজার বাস ভাড়া ১,০০০ টাকা থেকে ২,৬০০ টাকা পর্যন্ত। যেতে সময় লাগবে ৮ থেকে ৯ ঘন্টার মতো। রাত ১০ টায় ঢাকা থেকে রওনা দিলে সকাল ৭ টার মধ্যে কক্সবাজার পৌঁছে যাবেন।
ঢাকা থেকে ট্রেনে কক্সবাজার যেতে কমলাপুর রেলস্টেশন বা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রেলস্টেশন থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস বা পর্যটন এক্সপ্রেস ট্রেনে কক্সবাজার যেতে পারবেন। এসি, নন-এসি সিট ক্লাস ভেদে ঢাকা টু কক্সবাজার ট্রেন ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে ১,৭৫০ টাকা।
বাজেট বেশি থাকলে ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজার যেতে পারেন। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে নভোএয়ার, ইউএস-বাংলা, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ফ্লাইটে সরকারি কক্সবাজার যেতে পারবেন। ভাড়া সিট ক্লাস ভেদে ৩,৫০০ টাকা থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত। যেতে সময় লাগবে ৫৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা।
কক্সবাজার থেকে মেরিন ড্রাইভ রোড ভ্রমণ
কক্সবাজারের সুগন্ধা পয়েন্ট বা কলাতলী থেকে মেরিন ড্রাইভ রোডে যাওয়ার জন্য ছাদ খোলা জীপ, সিএনজি, অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে করে মেরিন ড্রাইভ রোড ঘুরে দেখতে পারেন।
অটোরিকশাতে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ঘুরে দেখতে অনেক বেশি সময় লাগবে। একদিনে সম্পূর্ণ মেরিন ড্রাইভ রোড সড়ক ঘুরে দেখতে চাইলে খোলা জীপ গাড়ি ভাড়া করুন। গাড়ি ভাড়া নির্ভর করে সিজনের উপর। সিজনে গাড়ি ভাড়া ৭,০০০ টাকা আর অফ সিজনে গাড়ি ভাড়া ৬,০০০ টাকা।
এছাড়া মেরিন ড্রাইভ রোডে ঘোরার জন্য পর্যটন বাস সার্ভিস রয়েছে। এই বাসে চড়ে মেরিন ড্রাইভ রোডের দুই পাশের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং পর্যটন স্থান গুলোতে নেমে ঘুরে দেখতে পারবেন।
সম্পূর্ণ মেরিন ড্রাইভ রোড ঘুরে আসতে প্রায় ৫ ঘন্টা সময় লাগবে। যদি সম্পূর্ণ মেরিন ড্রাইভ রোড এবং আসেপাশে দর্শনীয় স্থান গুলো ঘুরে দেখতে চান তাহলে গাড়ি ঠিক করার সময় ড্রাইভারকে বলে নিবেন। তা না হলে আসেপাশে অল্পকিছু জায়গা ঘুরিয়ে আনবে।
মেরিন ড্রাইভের দর্শনীয় স্থান
মেরিন ড্রাইভে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে মিনি বান্দরবান, হিমছড়ি ঝর্ণা ও পাহাড়, পাটুয়ারটেক, ঝাউবন, ইনানী বিচ, লাল কাঁকড়ার বিচ, লবণ চাষের ক্ষেত, জেলে পাড়া, টেকনাফ জিরো পয়েন্ট উল্লেখযোগ্য।
কোথায় থাকবেন
মেরিন ড্রাইভ রোড ঘুরে দেখতে হলে কক্সবাজার থাকতে হবে। কক্সবাজার থাকার জন্য প্রায় ৫০০ টির বেশি হোটেল, রিসোর্স আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হোটেল রিসোর্ট হল সায়মন বিচ রিসোর্ট, নিটোল রিসোর্ট, ইকরা বিচ রিসোর্ট, ইউনি রিসোর্ট, নীলিমা রিসোর্ট, হানিমুন রিসোর্ট, মারমেইড বিচ রিসোর্ট, ওশেন প্যারাডাইজ, কক্স টুডে, লং বীচ, উর্মি গেস্ট হাউজ, কল্লোল, মিডিয়া ইন, কোলাল রীফ, সী ক্রাউন, আইল্যান্ডিয়া ইত্যাদি।
কক্সবাজার বিচ ও মেইন রোড থেকে যত দূরে হোটেল বা রিসোর্ট ভাড়া নিবেন তত কম টাকায় হোটেল বা রিসোর্ট ভাড়া পাবেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কম টাকায় হোটেল, রিসোর্ট খুঁজতে রিকশাওয়ালা মামাদের পরামর্শ নিতে পারেন। তবে, খেয়াল রাখবেন তারা যেন তাদের পরিচিত হোটেল, রিসোর্টে নিয়ে কমিশন না খায়।
অফ সিজনে হোটেল রিসোর্ট গুলোর ভাড়া কিছুটা কম থাকে এবং সহজে রুম পেয়ে যাবেন। সিজনের সময় (ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস) অগ্রিম রুম বুকিং করে যাওয়া ভালো। হোটেলের ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অগ্রিম রুম বুকিং দিতে পারবেন।
কোথায় খাবেন এবং কি কি খাবেন
মেরিন ড্রাইভ রোডের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট আছে। চাইলে সেখান থেকে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেন। তবে এসব রেস্টুরেন্ট গুলোতে খাবারের দাম অনেক বেশি।
মেরিন ড্রাইভে ঘুরতে যাওয়ার সময় খাওয়ার জন্য সাথে কিছু শুকনো খাবার নিতে পারেন বা কক্সবাজার ফিরে এসে খেতে পারেন। অধিকাংশ পর্যটকেরা কক্সবাজার ফিরে এসে খাবার খায়।
কক্সবাজার খাবার জন্য বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট আছে। মিডিয়াম বাজেটের রেস্তোরাঁর মধ্যে ঝাউবন, ধানসিঁড়ি, নিরিবিলি, পৌষি, রোদেলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সিজন অনুসারে এই সব রেস্তোরাঁ গুলোতে খাবারের দাম একটু কম বেশি হয়ে থাকে।
কক্সবাজার রেস্তোরাঁ গুলোতে পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের খাবার তালিকায় সামুদ্রিক মাছ, শুঁটকি মাছের ভর্তা, বারবিকিউ ইত্যাদি।
FAQ (প্রশ্ন উত্তর)
মেরিন ড্রাইভ চান্দের গাড়ি ভাড়া কত টাকা?
মেরিন ড্রাইভ রোডে চান্দের গাড়ি ভাড়া সিজনের সময় ৭,০০০ টাকার মধ্যে এবং অফ সিজনের সময় ৬,০০০ টাকার মধ্যে। গাড়ি ভাড়া দামাদামি করে ঠিক করবেন।
মেরিন ড্রাইভ সড়কের দৈর্ঘ্য কত কিলোমিটার?
মেরিন ড্রাইভ সড়কের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটার। এটা কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত।