লালাখাল সিলেট – স্বচ্ছ ও নীল জলের নদী
লালাখাল সিলেট (Lalakhal sylhet) জেলার জৈন্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি পর্যটন পর্যটন এলাকা। সিলেট শহরের থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লালাখাল নদী ভারতের চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
লালখালের পানি স্বচ্ছ ও নীল রঙের। নদীর নাম লালাখাল হলেও পানির রং স্বচ্ছ নীল। স্বচ্ছ নীল রঙের পানি দেখে আপনার মনে হবে মালদ্বীপ সাগরের প্রতচ্ছবি। মূলতঃ জৈন্তায়া পাহাড় থেকে আসা পানির সাথে মিশে থাকা খনিজ ও কাদার পরিবর্তে নদীর বালুময় তলদেশের কারণে পানির রং নীল দেখায়।
পাহাড়, নদী, সবুজ বন, চা-বাগান, নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি সব মিলিয়ে লালাখালকে অন্যান্য করে তুলেছে। যারা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে চান তাদের জন্য আদর্শ জায়গা।
লালাখাল নদীতে অসংখ্য বাঁক রয়েছে। প্রত্যেকটি বাঁকের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। নদী থেকে পাহাড় গুলোকে দেখলে মনে হবে কেউ যেন নিজ হাতে থরেথরে পাহাড় পাহাড় কেঁটে একটির পর একটি সাজিয়েছে। পাহাড়ের চূড়ায় সাদা মেঘ ছুটে বেড়ায়।
তমামিল বিল অংশে লালাখালের নাম সারি নদী। এখানে খালের একেক অংশে এককে রঙের পানি। নীল, সবুজ ও স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে নৌকা বা স্পীড বোডে চড়ে লালাখালে যেতে পারবেন। ৪৫ মিনিটের এই যাত্রায় লালাখালের সমস্ত সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন নদীর নীল স্বচ্ছ পানির দিকে। অসম্ভব সুন্দর নীল স্বচ্ছ পানি একদম পানির নিচে পর্যন্ত দেখতে পারবেন। সন্ধ্যার পর নদীতে নৌকা বা স্পীড বোড থাকে না, তাই সন্ধ্যার মধ্যে লালাখাল ঘোরাঘুরি শেষ করতে হবে। তবে সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে লালাখালের চারপাশের সৌন্দর্য সারাজীবন মনে রাখার মতো।
লালাখাল সিলেট যাওয়ার উপযুক্ত সময়
লালাখাল ভ্রমণের উপযুক্ত সময় শীতকাল অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এসময় নদীর পানি স্বচ্ছ ও নীল রঙ থাকে। একেবারে নদীর নিচে পর্যন্ত দেখা যায়। এছাড়া শীতকালে অতিথি পাখিদের দেখা পাবেন। বর্ষাকালে নদীতে স্রোত থাকায় পানি ঘোলা থাকে।
লালাখাল সিলেট কিভাবে যাবেন
লালাখাল যেতে হলে প্রথমে আপনাকে সিলেট আসতে হবে। সিলেট শহর থেকে লালাখালের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার।
ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার উপায়
ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটগামী সৌদিয়া, গ্রীন লাইন, এস আলম, হানিফ, ইউনিক, শ্যামলী, সোহাগ, এনা, লন্ডন এক্সপ্রেস সহ যেকোনো পরিবহনে করে সিলেট যেতে পারবেন। এসি/নন-এসি বাস ভেদে ঢাকা টু সিলেট ভাড়া ৭০০ থেকে ১,৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে সিলেটের দূরত্ব ২৩৬ কিলোমিটার এবং যেতে সময় লাগবে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা।
ঢাকার কমলাপুর বা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত ও কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে করে সিলেট যেতে পারবেন। সিট ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৩৭৫ থেকে ১,২৮৮ টাকা।
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ, নভোএয়ার, ইউএস বাংলা ফ্লাইটে করে সিলেট যেতে পারবেন। ঢাকা টু সিলেট বিমান ভাড়া (ইকোনমি ক্লাস) ৪,৪০০ টাকা। যেতে সময় লাগে ৫৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা।
চট্টগ্রাম থেকে সিলেট যাওয়ার উপায়
চট্টগ্রাম থেকে বিআরটিসি, গ্রীন লাইন, শ্যামলী, হানিফ, এস আলম, সোহাগ, এনা, সৌদিয়া পরিবহন চট্টগ্রাম টু সিলেট রুটে চলাচল করে। চট্টগ্রাম টু সিলেট বাস ভাড়া ৯০০-১,৫০০ টাকা পর্যন্ত।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে প্রতি শনিবার বাদে প্রতিদিন রাত ৯:৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস ও প্রতি সোমবার বাদে প্রতিদিন সকাল ৮:১৫ মিনিটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস সিলেট যায়। ট্রেনের সিট ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৪৫০ টাকা থেকে ১,৫৪১ টাকা।
সিলেট থেকে লালাখাল যাওয়ার উপায়
সিলেট শহর থেকে জাফলংগামী লোকাল বাসে চড়ে সারিঘাট নেমে যাবেন। সিলেট শহর ও জাফলং এর মধ্যেবর্তী স্থান সারিঘাট। সারিঘাট থেকে লালাখাল যাওয়ার জন্য অটোরিকশা বা সিএনজি পাবেন। সারিঘাট থেকে লালাখাল নদী পথে নৌকায় চড়েও যেতে পারবেন।
সিলেট টু লালাখাল রোড়ে রাত ৮ টা পর্যন্ত গাড়ি চলাচল করে। তাই সন্ধ্যার আগে সিলেট শহরের ফিরে আসার চেষ্টা করবেন।
এছাড়া সিলেট শহর থেকে রিজার্ভ সিএনজি, লেগুনা বা প্রাইভেট কার নিয়ে লালাখাল ঘুরে আসতে পারেন। যদি একসাথে আরো ট্যুরিস্ট স্পট দেখতে চান তাহলে গাড়ি রিজার্ভ নেওয়া ভালো। রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া লাগবে ১,২০০-১৫০০ টাকা এবং প্রাইভেট কার ভাড়া লাগবে ২,৫০০-৩,০০০ টাকা।
লালাখাল নৌকা ভাড়া
লালাখাল নৌকা ঘাটে ঘোরাঘুরি করার জন্য ইঞ্জিন চালিত ছোট-বড় নৌকা ও স্পিডবোট ভাড়া পাওয়া যায়। সিজন ভেদে নৌকা ভাড়া কমবেশি হয়।
ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া প্রতি ঘন্টা ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা, বড় ইঞ্চিন চালিত নৌকা ভাড়া প্রতি ঘন্টা ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা। ছোট নৌকায় ৪-৫ জন এবং বড় নৌকায় ১০-১৫ জন বসতে পারবেন।
কোথায় খাবেন
খাবার জন্য লালাখালের আশেপাশে কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্ট নেই। বেশিভাগ পর্যটকেরা সিলেট থেকে সকালের নাস্তা করে লালাখাল গিয়ে আবার সিলেট ফিরে এসে খাবার খায়। চাইলে সাথে করে শুকনো খাবার ও পানি নিতে পারেন।
সিলেট শহরের জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থিত পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্ট, পালকি রেস্টুরেন্ট বা পানসী রেস্টুরেন্ট থেকে স্পল্পমূল্যে (২৫০-৩৫০ টাকায়) পছন্দের খাবার খেতে পারবেন। এছাড়া সিলেট শহরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আপনার পছন্দের জায়গা থেকে খাবার খেতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
লালাখাল থাকার জন্য নর্দান রিসোর্ট আপনার জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে। এখানে বুকিং করলে সিলেট শহর থেকে যাওয়া-আসা করার জন্য তাদের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে।
এছাড়া লালাখালের পাশে খাদিমনগর নাজিমগড় রিসোর্টে রাত্রিযাপন করতে পারেন। সিজনের সময় এখানে আগে থেকে রুম বুকিং দিতে হবে। এই রিসোর্টে আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন। প্রতি রাতের জন্য এখানে রুম ভাড়া ৭,০০০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত। সিজন অনুযায়ী ভাড়া কম বেশি হতে পারে।
অধিকাংশ পর্যটকেরা লালাখাল ঘুরে আবার সিলেট শহরে ফিরে এসে রাত্রিযাপন করে। সিলেট দরগা রোড় ও লামাবাজার এলাকায় কম টাকায় অনেক আবাসিক হোটেল ও গেস্ট হাউজ রয়েছে। এখানে ৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকার মধ্যে রুম পেয়ে যাবেন।
আপনার বাজেট বেশি হলে গুলশান, হোটেল হিল টাউন, দরগা গেইট, সুরমা, কায়কোবাদ হোটেলে থাকতে পারেন।
সিলেটের আরো দর্শনীয় স্থান
লালাখাল ছাড়াও সিলেটে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আমার পরামর্শ সিলেট ভ্রমণে গিয়ে হাতে কয়েক দিন সময় নিয়ে সিলেটের দর্শনীয় স্থান সমূহ ঘুরে দেখে আসবেন।
সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে জাফলং, রাতারগুল, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, বিছানাকান্দি, খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান, রাংপানি, শাপলা বিল, হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজার, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত উল্লেখ্যযোগ্য।
পরামর্শ
- সাঁতার না জানলে নদীতে নামবেন না।
- স্থানীয় মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
- বাস, সিএনজি, লেগুনা, হোটেল সহ যেকোনো পণ্য কেনাকাটা করার সময় দামাদামি করুন।
- পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না।
- সন্ধ্যার আগে সিলেট শহরে ফিরে আসুন।
- কম খরচে ভ্রমণ করতে গ্রুপ করে ভ্রমণ করুন।
আরো পড়ুন
- সিলেট ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
- সিলেট থেকে জাফলং কত কিলোমিটার
- সিলেট থেকে রাতারগুল কত কিলোমিটার
- সিলেট থেকে বিছানাকান্দি কত কিলোমিটার
- সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর কত কিলোমিটার