কুতুবদিয়া দ্বীপ, কক্সবাজার – কুতুবদিয়া ভ্রমণের বিস্তারিত তথ্য
কুতুবদিয়া দ্বীপ (Kutubdia Island) কক্সবাজার জেলার একটি দ্বীপ উপজেলা, যা কুতুবদিয়া চ্যানেল দ্বারা মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর কুতুবদিয়া দ্বীপে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। দ্বীপের রাণী কুতুবদিয়ার আয়তন ২১৬ বর্গ কিলোমিটার।
বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কূলে কুতুবদিয়ায় অবস্থান। এর উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে কুতুবদিয়া চ্যানেল, চট্টগ্রাম জেলার মহেশখালী উপজেলা, বাঁশখালী উপজেলা ও পেকুয়া উপজেলা অবস্থিত।
কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম তিন দিকে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্ব পাশে রয়েছে কুতুবদিয়া চ্যানেল। বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চল বা কক্সবাজার জেলা সদর থেকে কুতুবদিয়া উপজেলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছোট ডেনিস বোট, লঞ্চ ও স্টিমার।
এই দ্বীপে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদুৎ কেন্দ্র, বাতিঘর, সমুদ্র সৈকত, লবণ চাষের ক্ষেত, প্রাচীন দীঘির পাড়, সিটিজেন পার্ক এবং কুতুবউদ্দিন আউলিয়ার মাজার।
কুতুবদিয়া দ্বীপের ইতিহাস ও নামকরণ
ধারণা করা হয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে বঙ্গোপসাগরের বুকে কুতুবদিয়া দ্বীপ জেগে উঠে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই দ্বীপে মানুষের পদচারণা শুরু হয়।
হযরত কুতুবুদ্দীন নামে এক কামেল ব্যাক্তি তার কিছু অনুসারী নিয়ে মগ পর্তুগীজ বিতাড়িত করে এই দ্বীপে আস্তানা স্থাপন করেন। পরবর্তীতে আরাকান থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করলে এই দ্বীপে কুতুবুদ্দীন তাদের আশ্রায় দেয়।
নির্যাতিত মুসলমানেরা কুতুবুদ্দীনের প্রতি শ্রদ্ধান্তরে তার নাম অনুসারে এই দ্বীপের নামকরণ করেন কুতুবুদ্দীনের দিয়া। যা পরবর্তীতে কুতুবদিয়া নামে স্বীকৃতি লাভ করে। স্থানীয়ভাবে ঐসময় দ্বীপকে দিয়া বলা হতো।
বর্তমানে এই দ্বীপের বয়স ৬০০ বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রভাবে ভেঙ্গে এই দ্বীপের আয়তন প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেছে। অপূর্ব সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা দ্বীপটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকেরা ভীড় করে।
কুতুবদিয়া দর্শনীয় স্থান
কুতুবদিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অনেক দর্শনীয় স্থান আছে। এই দর্শনীয় স্থান গুলো দেখতে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকেরা কুতুবদিয়া আসে। নিচে কুতুবদিয়া দ্বীপের দর্শনীয় স্থান গুলো উল্লেখ করা হয়েছে।
কুতুবদিয়া চ্যানেল
কুতুবদিয়া চ্যানেল ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। শীতের সময় ছাড়া অন্যান্য সময় এই চ্যানেল উত্তাল থাকে। শীতের একদম শান্ত নদীর মতো হয় যায়। তাই শীতের সময় পর্যটকদের কুতুবদিয়া যাওয়ার উপযুক্ত সময়।
কুতুবদিয়া যাওয়ার জন্য মাগনামা ঘাট থেকে ডেনিস বোটে এই চ্যানেল পাড়ি দিতে হবে।
কুতুবদিয়া বাতিঘর
কুতুবদিয়া বাতিঘর বা লাইট হাউজ হচ্ছে সুউচ্চ ১২০ ফুট মিনায় আকারের একটি দালান সেখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আলো দিয়ে সমুদ্রের জাহাজের নাবিকদের দিক নির্দেশনা দেয়। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণফুলি নদীর মোহনায় এই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। ঐসময় এটা তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ৪,৪২৮ টাকা।
সে সময় প্রায় ২২০ কিলোমিটার দূর থেকে জাহাজের নাবিকরা রাতে এই আলো দেখতে পেত। পাকিস্তান আমলে এই বাতিঘর আবার নতুন করে তৈরি করা হয়। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ঘূর্ণিঝড়ে ওয়্যারলেস যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে জেনারেটরের মাধ্যমে বাতিঘরে আলো জ্বলে।
বায়ুবিদুৎ কেন্দ্র
বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় বায়ুবিদুৎ কেন্দ্র কুতুবদিয়ায় অবস্থিত। এখানে ১ হাজার কিলোমিটার বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ১৯৯৬ সালে সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণ প্রান্তে আলী আকবরের ডেল এলাকায় ৫০ টি ইউমিল স্থাপন করা হয়। বর্তমানে অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। পরে ২০১৫ সালে আবার নতুন করে ৫০টি ইউমিল স্থাপন করা হয়।
কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত
কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তর সৈকত। এখানে তেমন কোনো পর্যটকদের দেখতে পাবেন না। তবে জেলের মাছ ধরার দৃশ্য, লাল কাঁকড়ার ছোড়াছুড়ি, ঝাউবন এবং গাংচিল দেখতে পাবেন।
কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যাস্ত দেখার আদর্শ জায়গা। তাছাড়া নিরিবিলি এই সমুদ্র সৈকতে ক্যাম্পিং সেরা স্থান।
কুতুব আউলিয়ার দরবার
কুতুবদিয়া দ্বীপের ধুরং এলাকায় অবস্থিত কুতুব আউলিয়ার দরবার শরীফ। এই দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠাতা করেন শাহ আব্দুল মালেক। তিনি ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০০০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন।
প্রত্যেক বছর ৭ ফাল্গুন কুতুব আউলিয়ার দরবার শরীফে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে মিলাদ মাহফিল আয়োজন করে। এসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তার হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে। এই দরবার শরীফের সাথে মসজিদ, মাদ্রারাসা, এতিমখানা, কুরআন শিক্ষা স্থাপন করা হয়েছে।
লবণ চাষ
শীতের সময় কুতুবদিয়ায় প্রাকৃতিক ভাবে লবণের চাষ করা হয়। সবচেয়ে বেশি লবণ চাষ করা হয় তাবলের চর, আলী আকবরের ডেল ও কৈয়ার বিলে। যারা প্রাকৃতিকভাবে লবণ চাষ দেখতে চান তারা এখানে এসে কৌশল দেখে যেতে পারেন।
এছাড়া কুতুবদিয়ায় আরো দর্শনীয় স্থান গুলো মধ্যে মুক্তমঞ্চ, বড়ঘোপ স্টেডিয়াম, সিটিজেন পার্ক, ফকিরা মসজিদ, কালারমার মসজিদ, প্রাচীন দীঘির পাড়, শহীদ মিনার উল্লেখযোগ্য।
কুতুবদিয়া দ্বীপ কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে কুতুবদিয়া
ঢাকা থেকে কুতুবদিয়া যাওয়ার জন্য হানিফ পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, শ্যামলী, সৌদিয়া, গ্রীন লাইন, ঈগল, সেন্টমার্টিন, এস আলম পরিবহনে কক্সবাজার যেতে হবে। এসি / নন-এসি বাস ভেদে ভাড়া ১,০০০ টাকা থেকে ২,৬০০ টাকা পর্যন্ত। কক্সবাজার থেকে চকরিয়া উপজেলা বাস স্ট্যান্ড গিয়ে সেখান থেকে মগনামা ঘাট হয়ে ডেনিস বোটে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হয়ে কুতুবদিয়া যেতে হবে।
চট্টগ্রাম থেকে কুতুবদিয়া
চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ বাস স্ট্যান্ড বা বহদ্দারহাট বাস স্ট্যান্ড থেকে যেকোনো কক্সবাজারগামী বাসে চকরিয়া যাওয়া যায়। জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ১৭০-১৮০ টাকা, যেতে সময় লাগবে প্রায় ৩ ঘন্টার মতো। চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি করে জনপ্রতি ৭০-৮০ টাকা (রিজার্ভ ৩০০-৩২০ টাকা) ভাড়ায় মগনামা ঘাট যেতে পারবেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম নতুন ব্রিজ থেকে সিএনজি দিয়ে জনপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়ায় মগনামা ঘাট যেতে পারবেন। সিএনজিতে যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মতো। এছাড়া চট্টগ্রাম ফিরিঙ্গা বাজার থেকে সকাল ৭ টায় ১২০ টাকা ভাড়া দিয়ে ট্রলারে সরাসরি কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ ঘাট বা দরবার ঘাটে যেতে পারবেন। কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ ঘাট থেকে বড়ঘোপ বাজার যেতে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া লাগবে।
কক্সবাজার থেকে কুতুবদিয়া
কক্সবাজার থেকে কুতুবদিয়া যেতে প্রথমে চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড যেতে হবে। চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি করে জনপ্রতি ৭০-৮০ টাকা (রিজার্ভ ৩০০-৩২০ টাকা) ভাড়ায় মগনামা ঘাট যেতে পারবেন।
মগনামা ঘাট থেকে ডেনিস বোটে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ ঘাট বা দরবার ঘাটে যেতে হবে। ঘাট থেকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে বড়ঘোপ বাজার যেতে পারবেন।
কোথায় থাকবেন
কুতুবদিয়া পর্যটকদের থাকার জন্য বড়ঘোপ বাজারে “হোটেল সমুদ্র বিলাস” নামে একটি আবাসিক হোটেল আছে। ৮০০-১২০০ টাকার মধ্যে বিভিন্ন মানের নন-এসি রুম পাবেন। অগ্রিম রুম বুকিং করতে যোগাযোগ করুন ০১৭২২-০৮৬৮৪৭, ০১৮১৯-৬৪৭৩৫৫ মোবাইল নাম্বারে।
হোটেল সমুদ্র বিলাস থেকে কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত দেখতে পাবেন। যারা নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতে ক্যাম্পিং করতে চান তাদের জন্য এই দ্বীপ আদর্শ জায়গা।
কোথায় খাবেন এবং কি খাবেন
কুতুবদিয়ায় খাবার জন্য খুব ভালো মানের রেস্টুরেন্ট না থাকলেও স্থানীয় বাজরে মাঝারি মানের কয়েকটি খাবার হোটেল আছে। সেখান থেকে ভাত-ডাল, শুঁটকি, ভর্তা, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, মাংস দিয়ে ভরপুর খেতে পারবেন।
খাবার আগে অবশ্যই খাবারের দাম জেনে নিবেন। কুতুবদিয়া বাজারে স্থানীয় হোটেল গুলোর মধ্যে “ক্যাফে আলম” ও “নিউ মদিনা” হোটেল উল্লেখযোগ্য।এই হোটেল গুলোতে খাবারের মান অনেক ভালো।
একদিনে কুতুবদিয়া ভ্রমণ ও খরচ
যারা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখতে গেছেন তারা একদিন সময় হাতে নিয়ে কুতুবদিয়া বাতিঘর, বায়ুবিদুৎ কেন্দ্র, কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত, কুতুব আউলিয়ার দরবার শরীফ, লবণ চাষ দেখে আসতে পারেন।
কক্সবাজার থেকে কুতুবদিয়া যেতে প্রথমে চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড যেতে হবে। চকরিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি করে জনপ্রতি ৭০-৮০ টাকা (রিজার্ভ ৩০০-৩২০ টাকা) ভাড়ায় মগনামা ঘাট যেতে হবে।
মগনামা ঘাট থেকে ট্রালারে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ ঘাট বা দরবার ঘাটে যেতে হবে। ঘাট থেকে ৮০০-১,০০০ টাকায় রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া করে কুতুবদিয়ার দর্শনীয় স্থান গুলো ঘুরিয়ে আবার ঘাটে নিয়ে আসবে। সন্ধ্যার আগে ঘাটে ফিরে আসবেন, সন্ধ্যার পর ঘাট থেকে ট্রলার ছাড়া না।