টাঙ্গুয়ার হাওর (Tanguar Haor) বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ১২৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর মিঠাপানির জলাভূমি। এর মোট আয়তন ৬,৯১২ একর, তবে বর্ষাকালে আয়তন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২০,০০০ একর পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওরের সম্পূর্ণ অংশ পানির নিচে ডুবে গেলেও শীতকালে পানি কমতে থাকে এবং বড় একটি অংশ শুকিয়ে যায়। বর্তমানে এই হাওরে ছোট-বড় ১৪১ প্রজাতির মাছ, ২০৮ প্রজাতির পাখি, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২১ প্রজাতির সাপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১ প্রজাতির উভরচর প্রাণীর আবাসস্থল।
টাঙ্গুয়ার হাওর এর লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল পাখির অভয়ারণ্য। শীত মৌসুমে এখানে ২৫০ প্রজাতির কয়েক লাখ অতিথি পাখির আগমন ঘটে। কিছু কিছু জায়গায় ১ কিলোমিটারে বেশি এলাকা জুড়ে অতিথি পাখিদের ভেসে বেড়াতে দেখা যায়।
এই হাওরের পানি পরিস্কার ও স্বচ্ছ হওয়ায় উপর থেকে তলা পর্যন্ত দেখা যায়। বর্ষাকালে সম্পূর্ণ হাওর ঘুরে দেখার জন্য হাউজ বোট ও নৌকার ব্যবস্থা রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড় দেখতে পাবেন। মেঘালয় পাহাড়ের প্রায় ৩০ টি ছোট-বড় ঝর্ণা হাওরে এসে মিশেছে।
এক নজরে সম্পূর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার জন্য একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। বর্ষাকালে নৌকায় করে ওয়াচ টাওয়ারে যেতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট-বড় প্রায় ৪৬ টি ভাসমান গ্রাম বা দ্বীপ রয়েছে। বর্ষাকালে এসব গ্রামের মানুষের যাতায়াতের প্রধান যানবাহন নৌকা।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার টাঙ্গুয়ার হাওরকে Ecologically Critical Area (ECA) হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার সাইট এর তালিকায় স্থান পায়।
চারিদিকে অথৈ পানি, নীল আকাশ, জলাবন, মেঘালয় পাহাড় এমন প্রকৃতিক দৃশ্য একত্রে হাউজ বোটে ঘুরে দেখার জন্য আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
বর্ষাকাল অর্থাৎ (জুন থেকে অক্টোবর মাস) টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। এসময় হাওরে পানি বেশি থাকায় নৌকায় চড়ে সম্পূর্ণ হাওর ঘুরে বেড়ানো যায়। শীত ও গ্রীষ্মকালে সাধারণত হাওরের পানি কম থাকে। তবে, শীতকালে হাওরে অসংখ্য অতিথি পাখিদের দেখা মিলে।
টাঙ্গুয়ার হাওর কি কি দেখবেন
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ মানে শুধু হাওর, জলবন, ওয়াচ টাওয়ার ও অতিথি পাখি দেখা নয়। এর সাথে আরো এমন কয়েকটি স্পট রয়েছে যেগুলো সবাই ঘুরে দেখে।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ প্যাকেজের সাথে সোয়াম্প ফরেস্ট, শিমুল বাগান, বারিক টিলা, নিলাদ্রি লেক, যাদুকাটা নদী, লাউড়ের গড় ইত্যাদি ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে দেখতে পারেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর কিভাবে যাব
টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে চাইলে প্রথমে আপনাকে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে আসতে হবে। দেশের যেকোনো স্থান থেকে বাসে সুনামগঞ্জ আসতে পারবেন।
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ: ঢাকার সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন মামুন, শ্যামলী পরিবহন, হানিফ পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি/নন-এসি বাস ছেড়ে যায়। নন-এসি বাস ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যেতে সময় লাগবে প্রায় ৬ ঘন্টা।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ: সিলেটের কুমারগাঁও বাস টার্মিনাল থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য বাস রয়েছে। জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে সুনামগঞ্জ যেতে পারবেন। বাসে যেতে সময় লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা।
এছাড়া শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য লাইট গাড়ি রয়েছে। জনপ্রতি ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে সুনামগঞ্জ যেতে পারবেন।
সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওর: সুনামগঞ্জ শহর থেকে (বর্ষা মৌসুমে) সিএনজি / লেগুনা / মোটরসাইকেল ভাড়া করে তাহিরপুর নৌকা ঘাটে যাবেন। সেখান থেকে আপনার সামর্থ অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখতে পারবেন।
শীত মৌসুমে হাওরের পানি কম থাকায় সুনামগঞ্জ শহর থেকে সিএনজি / লেগুনা / মোটরসাইকেল ভাড়া করে সোলেমানপুর যেতে হবে। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে হাওর ঘুরে দেখতে পারবেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর নৌকা ভাড়া ও হাউজ বোট
টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখার জন্য এবং রাত্রিযাপন করার জন্য বিভিন্ন ক্যাটাগরির হাউস বোট, সেমি হাউজ বোট ও গতানুগতিক নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। হাউজ বোটের ক্যাটাগরি অনুযায়ী একেক হাউজ বোটের প্যাকেজ বা ভাড়া একেক রকম।
হাউজ বোটে এক রাত থাকা, সব বেলা খাওয়া সহ হাওরের আশেপাশে সকল ট্যুরিস্ট স্পট ঘুরে দেখার জন্য বিভিন্ন প্যাকেজ রয়েছে। হাউজ বোটের প্যাকেজের মধ্যে সবকিছু অন্তর্ভুক্ত। বুকিং করার আগে অবশ্যই তাদের প্যাকেজ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিবেন।
- প্রিমিয়াম হাউজ প্যাকেজ (জনপ্রতি) ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা
- সেমি হাউজ বোট (জনপ্রতি) ৪,০০০ থেকে ৬,০০০ টাকা
- ছোট নৌকা (জনপ্রতি) ২,৫০০ থেকে ৩,০০০ টাকা
- পুরো হাউজ বোট রিজার্ভ ৪৫,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা
এছাড়া ড্রে ট্রিপে কম খরচে হাওর ঘুরে বেড়ানোর জন্য লোকাল বড়ির নৌকা ভাড়া পাবেন। নৌকা ভাড়া করার সময় অবশ্যই দামাদামি করে ভাড়া ঠিক করবেন। টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউজ বোট তথ্য জানতে এই আর্টিকেলটি পড়ুন।
নৌকা মাঝিদের মোবাইল নাম্বার
- হাবলু ভাই (ট্রলারের মালিক) 01741-248761
- জুয়েল ভাই (মাঝি) 01783-513339
- ফজলু ভাই (মাঝি) 01719-659445
- সেজুল ভাই (মাঝি) 01795-805832
কোথায় থাকবেন
টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে এসে অধিকাংশ পর্যটকেরা হাউজ বোটে রাত্রিযাপন করে। যারা ড্রে ট্রিপে হাওর ঘুরে বেড়াতে চান তারা সুনামগঞ্জ শহরে এসে আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারেন। সুনামগঞ্জে ৪০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে থাকার জন্য আবাসিক হোটেল পাবেন। সুনামগঞ্জ আবাসিক হোটেল তথ্য জানুন।
- হোটেল প্যালেস – পুরাতন বাস টার্মিনাল, স্টেশন রোড়।
- হোটেল নূরানী – পুরাতন বাস টার্মিনাল, সুনামগঞ্জ।
- হোটেল নূর – পূর্ববাজার স্টেশন রোড়, সুনামগঞ্জ।
- হোটেল সারপিনিয়া – জগন্নাথবাড়ি রোড, সুনামগঞ্জ।
- হোটেল মিজান – পূর্ব বাজার, সুনামগঞ্জ।
- সুরমা ভ্যালী আবাসিক রিসোর্ট, সুনামগঞ্জ।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা
হাউজ বোটে হাওর ভ্রমণের প্যাকেজে খাবার ব্যবস্থা থাকে। তাই যারা হাউজ বোটে হাওর ভ্রমণ করবেন তাদের খাবার চিন্তা করতে হবে না।
এছাড়া যারা দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে চান তারা সকালে তাহিরপুর বাজার খাবার হোটেল থেকে সকালের নাস্তা শেষে হাওর ঘুরে ফিরে এসে দুপুর বা রাতের খাবার আবার হোটেল থেকে খেতে পারবেন।
যদি আপনি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দুপুরের খাবার নৌকায় রান্না করে খেতে চান তাহলে তাহিরপুর বাজার থেকে রান্নার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নৌকায় রান্না করে খেতে পারেন। হাওরের তাজা মাছ কেনার জন্য হাওরের মাঝখানে ছোট ছোট বাজার গুলোতে যাবেন।
২ দিন ১ রাত টাঙ্গুয়ার হাওর ট্যুর প্ল্যান
সপ্তাহের যেকোনো দিন রাতের বাসে করে সুনামগঞ্জ ভেরে পৌঁছে যাবেন। সুনামগঞ্জ শহর থেকে নাস্তা শেষ করে সিএনজি বা লেগুনা করে তাহিরপুর নৌকা ঘাটে চলে যাবেন। যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টার মতো। তাহিরপুর বাজার থেকে নৌকা ভাড়া করে নৌকায় উঠার আগে ২ দিনের জন্য প্রয়োজনীয় বাজার করে নৌকায় উঠুন।
চেষ্টা করবেন ঘাট থেকে ৯ টার আগে নৌকা ছাড়ার জন্য। নৌকা সোজা নিয়ে যাবেন হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। সেখানে জলবনের মধ্যে ছোট নৌকায় করে ঘুরে বেড়াতে পারবেন এবং জলাবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। অধিকাংশ পর্যটকেরা দুপুর এখানে গোসল করে।
ওয়াচ টাওয়ারের উপরে উঠে দিগন্তজোড়া জলরাশি দেখে নৌকা নিয়ে চলে যাবেন টেকেরঘাটের দিকে। যেতে যেতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিবেন। নৌকা যত টেকেরঘাটের দিকে যাবে মেঘালয়ের পাহাড় গুলো ততই কাছ থেকে দেখতে পাবেন।
টেকেরঘাটে নৌকা বেঁধে নৌকায় রাত্রিযাপন করে সকালে শিমুল বাগান, যাদুকাটা নদী ও বারিক টিলা দেখতে চলে যাবেন। বর্ষকালে হাওরে প্রচুর পানি থাকে তাই নৌকায় চড়ে সব জায়গায় যেতে পারবেন। কিন্তু শীতকালে মোটরসাইকেল চলে এসব স্থান গুলোতে যেতে হবে।
শিমুল বাগান, যাদুকাটা নদী ও বারিক টিলা দেখে দুপুরের মধ্যে টেকেরঘাট ফিরে আসার চেষ্টা করবেন। দুপুরের খাবার খেতে সন্ধ্যার মধ্যে তাহিরপুর নৌকা ঘাটে চলে আসবেন। নৌকা ঘাট থেকে সিএনজি বা লেগুনা করে সুনামগঞ্জ শহরে চলে আসবেন। সুনামগঞ্জ শহর থেকে রাতের খাবার খেতে বাসে চড়ে আবার নিজের গন্তব্যে চলে আসতে পারবেন।
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ পরামর্শ ও সতর্কতা
- কম খরচে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে যেতে চাইলে ৪-৫ বা ৭-৮ জনের গ্রুপ করে ছুটির দিন বাদে যাবেন।
- সাঁতার না জানলে হাওরে নামবেন না, প্রয়োজনে সাথে লাইফ জ্যাকেট সাথে নিবেন।
- যেকোনো কিছু কেনার আগে অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
- হাওরে জলাবনের পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবেন না।
- খাবারের অবশিষ্ট অংশ, প্যাকেট, ময়লা আবর্জনা হাওরে ফেলবেন না।
- বজ্রপাত হলে নৌকায় ভিতর অবস্থান করুন।
- হাওরে উচ্চ শব্দে বক্স বা মাইক বাজাবেন না।
- রাতে নৌকায় অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো ব্যবহার করবেন না।
- হাওরের বন্যপ্রাণী বা পাখি শিকার করবেন না।
- নৌকায় মাঝির সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
- টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে সাথে নিবেন ছাতা, সানগ্লাস, ক্যাপ, গামছা, টর্চ লাইট, পাওয়ার ব্যাংক, প্রয়োজনীয় ঔষুধ, টয়লেট পেপার, খাবার পানি ইত্যাদি।
আরো পড়ুন
- সিলেট ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
- শাপলা বিল সিলেট
- খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান
- রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট
- রাংপানি সিলেট