নিকলী হাওর ভ্রমণ গাইড

বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত নিকলী হাওর (Nikli Haor)। নিকলী উপজেলা থেকে এই হাওরের উৎপত্তি হলেও মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। নিকলী উপজেলার নাম অনুসারে এই হাওরের নামকরণ করা হয়েছে। এই হাওর যেন প্রকৃতির বিশাল এক জলছবি।

রাজধানী ঢাকা থেকে ১১০ কিলোমিটার এবং কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির জলাভূমি ও জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র নিকলী হাওর।

২০২০ সালে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম সড়ক তৈরি করার পর এই হাওরের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পায়। বর্ষাকালে রাস্তা ও দুপাশের পানি এক হয়ে নতুন দৃশ্যের জন্ম দেয়। দূরে তাকালেই মনে হয় যেন জলের মাঝে মিলে গেছে রাস্তা। হাওরে নৌকায় ঘুরে বেড়ালে দেখতে পাবেন চারদিকে বিস্তৃর্ণ জলরাশি, দ্বীপের মতো ছোট ছোট গ্রাম ও ঘরবাড়ি, স্বচ্ছ জলের খেলা এবং রাতারগুলের মত ছোট জলাবন।

হাওরের একটি প্রবাদ আছে “বর্ষায় নাও আর শুকনোই বাও। অর্থাৎ শুকনো মৌসুমে পায়ে চলাচল হলেও বর্ষা মৌসুমে নৌকা চলাচলের একমাত্র মাধ্যম।  তবে ২০২০ সালে সড়ক তৈরির পর এই প্রবাদ যেন কিছুটা মিথ্যা হয়ে গেছে।

BM Khalid Hasan Sujon

নিকলী হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

বর্ষা মৌসুমে হাওরের পানি কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। তাই নিকলী হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল অর্থাৎ জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। এসময় হাওর ভ্রমণে গেলে পানির আসল সৌন্দর্য দেখতে পাবেন। আবার শীতকালে পানি শুকিয়ে যায় তখন হাওরের ভিন্ন সৌন্দর্য দেখতে পাবেন।

নিকলী হাওর যাবার উপায়

রাজধানী ঢাকা, কিশোরগঞ্জ বা আশেপাশের অন্যান্য জেলা থেকে বাস, ট্রেন এবং সিএনজি করে নিকলী যেতে পারবেন। 

বাসে ঢাকা টু নিকলী হাওর যাবার উপায়

ঢাকা টু নিকলী বাসে যেতে চাইলে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে জলসিড়ি বা উজানভাটি বাস অথবা গোলাপবাগ, গুলিস্তান থেকে অনন্যা সুপার ও যাতায়াত বাসে চড়ে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলা বাস টার্মিনালে নেমে যাবেন।

BM Khalid Hasan Sujon

প্রতিদিন ভোর ০৫:৩০ মিনিটে বাস ছেড়ে যায়। যেতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা। বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। কটিয়াদি বাস টার্মিনাল থেকে নিকলী যাবার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম সিএনজি।

কটিয়াদি বাস টার্মিনাল থেকে ২২ কিলোমিটার দূরত্বে নিকলী যেতে লোকাল সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ১২০ টাকা, রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া ৬০০ টাকা। সিএনজিতে কটিয়াদি থেকে নিকলী নৌকা ঘাট যেতে সময় লাগবে ১ ঘন্টা ২০ মিনিট।

এছাড়া ঢাকার গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে জনপ্রতি ৩০০ টাকা দিয়ে সিএনজি করে নিকলী উপজেলা সদর আসতে পারেন।

ঢাকা থেকে ট্রেনে যাবার উপায়

ঢাকা থেকে ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে আন্তঃনগর এগারো সিন্ধুর প্রভাতী ট্রেনে যেতে হবে। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রতি বুধবার বাদে সপ্তাহের বাকি ৬ দিন সকাল ০৭:১৫ মিনিটে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ট্রেনের আসন ভেদে জনপ্রতি ভাড়া ১৩৫ থেকে ৩৬৮ টাকা পর্যন্ত।

BM Khalid Hasan Sujon

ট্রেনে আসলে সবচেয়ে ভালো হয় কিশোরগঞ্জ সদরে পৌঁছানোর আগে মানিকখালী বা গচিহাটা রেলস্টেশনে নেমে গেলে। মানিকখালি বা গচিহাটা রেলস্টেশন থেকে সিএনজি বা ইজিবাইক করে খুব সহজে নিকলী যেতে পারবেন। সিএনজি বা ইজিবাইকে জনপ্রতি ভাড়া লাগবে ৬০-৭০ টাকা এবং রিজার্ভ নিলে ৩৫০-৪০০ টাকা । যেতে সময় লাগবে প্রায় ৪০ মিনিট। একই দিনে ঢাকা ফিরতে চাইলে বাসে আসতে হবে।

কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলী যাবার উপায়

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে সহজে নিকলী নৌকা ঘাট যেতে চাইলে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন সংলগ্ন সিএনজি স্টেশন আসুন। সেখান লোকল বা সিএনজি রিজার্ভ করে নিকলী যেতে পারবেন। লোকাল সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ৭০-৮০ টাকা এবং রিজার্ভ ৪৫০-৫০০ টাকা। কিশোরগঞ্জ টু নিকলী দূরত্ব প্রায় ২৭ কিলোমিটার। সিএনজিতে যেতে সময় লাগবে প্রায় ১ ঘন্টা।

ভৈরব থেকে নিকলী যাবার উপায়

ভৈরব থেকে লোকাল বা রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া করে নিকলী যেতে পারবেন। লোকাল সিএনজি ভাড়া জনপ্রতি ১২০-১৩০ টাকা এবং রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া ৫৫০-৬০০ টাকা। ভৈরব থেকে নিকলী যেতে সিএনজিতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট।

ময়মনসিংহ থেকে নিকলী যাবার উপায়

ময়মনসিংহ থেকে নিকলী যেতে বাসে কিশোরগঞ্জ জেলা সদর চলে যাবেন। কিশোরগঞ্জ সদর থেকে সিএনজি করে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের সামনে নিকলী সিএনজি স্টেশন আসবেন। সেখান থেকে লোকাল সিএনজিতে জনপ্রতি ১০০ টাকা এবং রিজার্ভ সিএনজিতে ৪৫০-৫০০ টাকা নিকলী চলে আসবেন।

সিএনজি ও নৌকা ভাড়া নেওয়ার সময় অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।

কটিয়াদি, গচিহাটা, মানিকখালী, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব যেখান থেকে নিকলী আসেন না কেনো রাস্তার দুপাশের গ্রামের দৃশ্য দেখতে ভালো লাগবে। এই প্রকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন নিকলী পৌঁছে যাবেন বুঝতে পারবেন না।

কোথায় খাবেন

নিকলী পৌঁছে সিএনজি থেকে যেখানে নামবেন সেখানে খাবার জন্য মোটামুটি মানের বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাবার হোটেল ক্যাফে ঢেউ ও হোটেল সেতু।

এসব হোটেলে হাওড়ের তাজা মাছ, মাছের ভর্তা, হাঁসের মাংস, মুরগীর মাংস, গরুর মাংস সহ বিভিন্ন আইটেমের খাবার পাবেন। হাওরের তাজা মাছ খেতে ভুল করবেন না। কম খরচে ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে ভরপেট খেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

বর্তমানে নিকলী হাওর জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় পর্যটকদের কথা চিন্তা করে মোটামুটি মানের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে নিকলী বেড়িবাঁধের কাছে আলম রিসোর্ট, চেয়ারম্যান গেস্ট হাউজ (01956-071563), হাওর প্যারাডাইস (01323-392003) সহ মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল আছে।

এছাড়া নিকলী উপজেলা ডাক বাংলো তে অনুমতি নিয়ে থাকতে পারেন। বন্ধুরা মিলে নৌকায় ক্যাম্পিং করতে পারেন তবে নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিতে পারেন।

কিভাবে নিকলী হাওর ঘুরে দেখবেন

সিএনজি থেকে নেমে প্রয়োজনীয় কাজ ও খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সিএনজি করে বেড়ি বাঁধের শেষ প্রান্তে নৌকা ঘাটে চলে আসুন। সেখান থেকে আপনার হাতে থাকা সময় অনুযায়ী কয়েক ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া করুন। ছোট নৌকা ভাড়া প্রতি ঘন্টা ৩০০-৪০০ টাকা এবং বড় নৌকা ভাড়া প্রতি ঘন্টা ৭০০-৮০০ টাকা (অবশ্যই ভাড়া দামাদামি করে নিবেন)। একটি নৌকায় ১০-২০ জন উঠতে পারবেন।

নৌকা ভাড়া করে হাওরের চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রথমে যাবেন ছাতিরচর গ্রামে। সেখানে সিলেটের রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট এর মত জলাবন আছে। জলাবনের ভিতর নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এখানে অনেক গোসল করে, পানিতে লাফালাফি করে আপনি করতে পারেন। সাঁতার না জানলে লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিবেন।

জলাবনের সৌন্দর্য ও গোসল শেষে নৌকা নিয়ে চলে যাবেন চর মনপুরায়। অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিতে চর মনপুরা ডুবে যায়। তবে পানি কম থাকলে এই চরে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। এরপর পড়ন্ত বিকালের সূর্য দেখতে দেখতে নিকলী বেড়ি বাঁধ ঘাটে ফিরে আসবেন।

নিকলী হাওর ঘুরে দেখার পাশাপাশি মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা হাওর ঘুরে দেখতে পারেন। নৌকায় নিকলী নৌকা ঘাট থেকে মিঠামইন যেতে প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগে। নৌকায় মোটরসাইকেল নেওয়ার সুবিধা পাবেন। মিঠামইন থেকে মোটরসাইকেল বা সিএনজি করে হাওরের সড়ক ধরে অষ্টগ্রাম যেতে পারবেন।

মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম সড়ক মোটরসাইকেল বা সিএনজি করে ঘুরে বেড়ানোর জমাই আলাদা। ঘুরে দেখতে পারেন মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট। এখানে প্রতিদিন দর্শনার্থীরা ভিড় জমায়।

খরচ কত

ভ্রমণ টিপস সব সময় বাজেটের মধ্যে ট্যুর প্ল্যান করে। ঢাকা থেকে নিকলী বাস ভাড়া ৩০০-৩৫০ টাকা। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ ট্রেন ভাড়া ১৩৫-২৪৮ টাকা। মানিকখালী বা গচিহাটা রেলস্টেশন থেকে নিকলী পর্যন্ত লোকাল সিএনজি ভাড়া ৬০-৭০ টাকা, রিজার্ভ ৩৫০-৪০০ টাকা।

সকলের নাস্তা খরচ ৬০-৭০ টাকা এবং দুপুরের খাবার খরচ ২৫০-৩০০ টাকা। নিকলী নৌকা ঘাট থেকে প্রতি ঘন্টা নৌকা ভাড়া ৩০০-৪০০ থেকে ৫০০-৬০০ টাকা। ৫-৬ ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া ২,০০০-৩,০০০ টাকা পর্যন্ত।

একদিনে নিকলী হাওর ট্যুর প্ল্যান

আপনি চাইলে ঢাকা থেকে একদিনে নিকলী হাওর ঘুরে আসতে পারেন। এজন্য ঢাকা থেকে সকালে বাস বা ট্রেনে রওনা দিলে নিকলী হাওর দেখে রাতে আবার ঢাকা ফিরতে পারবেন। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে খুব সকালে রওনা দিবেন। প্রতিদিন ভোর ৫:৩০ মিনিটে বাস এবং সকাল ৭:১৫ মিনিটে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে ট্রেন ছেড়ে যায়।

বাসে আসলে কটিয়াদি বাস টার্মিনাল নেমে যাবেন। ট্রেনে আসলে কিশোরগঞ্জের আগে মানিকখালী বা গচিহাটা রেলস্টেশনে নেমে যাবেন। সেখান থেকে লোকাল সিএনজিতে ৬০-৭০ টাকা ভাড়া দিয়ে নিকলী যেতে পারবেন।

নিকলী পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া ও প্রয়োজনীয় কাজ শেষে সিএনজি করে বেড়ি বাঁধের শেষে নৌকা ঘাট চলে যাবেন। সেখান থেকে কয়েক ঘন্টার জন্য নৌকা ভাড়া করে নিকলী হাওর ঘুরে দেখবেন। প্রথমে যাবেন ছাতিরচর গ্রামে এরপর যাবেন চর মনপুরায়।

বিকালে মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম সড়ক পথে সিএনজি বা মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন। মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট অনেক জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান।

এভাবে সারাদিন ঘুরে ফিরে নিকলী থেকে সিএনজি করে কটিয়াদি এসে সেখান থেকে ঢাকার বাস পেয়ে যাবেন। কটিয়াদি থেকে ঢাকার বাস ছাড়ার শেষ সময় সন্ধ্যা ৭ টা। ট্রেনে আসতে চাইলে বিকাল ৪ টার আগে মানিকখালী বা গচিহাটা রেলস্টেশনে চলে যাবেন।

নিকলীর আরো দর্শনীয় স্থান

নিকলী হাওরের আশেপাশে আরো বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে নিকলী বেড়ি বাঁধ, গুরই প্রাচীনতম আখড়া, পাহাড় খাঁর মাজার, গুরই শাহী জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য।

প্রশ্ন উত্তর (FAQ)

ঢাকা টু নিকলী হাওর কত কিলোমিটার?

ঢাকা টু নিকলী হাওর ১১০ কিলোমিটার।

কিশোরগঞ্জ থেকে নিকলী হাওর কত কিলোমিটার?

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর থেকে নিকলী হাওর ২৫ কিলোমিটার।

আরো পড়ুন